ক্রেডিট কার্ড ভয়াবহ এক খরচাস্ত্র- এর ব্যবহারে সতর্কতা জরুরী



  

ক্রেডিট কার্ড ভয়াবহ এক খরচাস্ত্র- এর ব্যবহারে সতর্কতা জরুরী 

- সাইফুল হোসেন 




দুই দশক আগের কথা। আমার এক বন্ধু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। ওখানে আবার একটু পড়াশুনা করে চাকরী নেয় একটা আইটি কোম্পানিতে। বেশ দক্ষ আর চৌকশ হবার কারণে তার পারফরম্যান্স খুব ভাল হল ফলস্বরূপ বেড়ে গেল বেতন। অদ্ভুত ব্যাপার হল বেতন বাড়ার কিছুদিন পর থেকে তাঁর চলতে কষ্ট হতে লাগলো। কারণ সে বেতন বাড়ার সাথে সাথে বাসা পরিবর্তন করেছিল। খাবার দাবার পোশাক এসবেও খানিকটা পরিবর্তন হল, বন্ধুবান্ধবের সার্কেলে এলো কিছু সংযোজন বিয়োজন। তাঁর চলতে কষ্ট হবার সবচেয়ে বড় কারণ সে কোন ফাঁকে যে তাঁর ক্রেডিট কার্ডের বর্ধিত সীমা শেষ করে ফেলেছিল সেটা খেয়াল করেনি। হাতে টাকা নেই, ক্রেডিট কার্ডের সীমা শেষ এখন কি করা। তাঁর ছিল আকাধিক ক্রেডিট কার্ড। সবগুলোর একই অবস্থা হল। কারণ আয় যে পরিমাণ বৃদ্ধি পায় অনেকসময় খরচের বৃদ্ধি তার চেয়ে বেশী হয়। তাছাড়া আবার ভবিষ্যতে আয় বাড়বে এই প্রত্যাশাতেও বর্তমানের খরচ বেড়ে যায় অনেকের। বিপত্তি ঘটে তখন যখন আয়ের বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায় খরচের বৃদ্ধি। আর যদি হাতে থাকে অত্যাধুনিক খরচাস্ত্র ক্রেডিট কার্ড, তাহলে তো কথা-ই নেই। খরচ বাড়ানোর অনুসঙ্গটি সঙ্গেই আছে। আমার বন্ধুটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। বাংলাদেশী হলেও সে পশ্চিমা ধাঁচের ভোগবাদীতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।  
প্রসঙ্গত বলতে চাই যে পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে সব বিষয়ে অনেক এগিয়ে তাতে কোন সন্দেহ নেইতারা নিয়ম-কানুন, টেকনোলজিত, অস্ত্র গোলাবারুদ ও ভোগ বিলাসে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়েতাদের মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে অনেকগুণ বেশী আমরা যেখানে আমাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমসিম খাই সেখানে তারা বসবাস করছে ভোগের সর্বোচ্চ পর্যায়েমৌলিক চাহিদা তাদের মিটে গেছে অনেক আগেতবে আর একটা বিষয়ে তারা অনেক এগিয়ে আমাদের মত গরীব দেশের তুলনায়তা হচ্ছে তাদের অধিকাংশ পরিবার ভবিষ্যতের দুই তিন বা তারও বেশি বছরের সম্ভাব্য আয়কে খরচ করে ফেলেছে তাও আবার সুদেকিভাবে? এই প্রশ্ন আসতে পারেকানাডা বা আমেরিকার কোন কোন পরিবারে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা নয় থেকে বারোটাযখন তাদের ক্রেডিট কার্ডের লিমিট বাড়ে তখন তারা পার্টির আয়োজন করেউল্লেখ্য যে আমার বন্ধুটিও ক্রেডিট কার্ডের সীমা বাড়ার পর বন্ধুদের আপ্যায়ন করেছিল।
এখন আমাদের দেশেও পাশ্চাত্যের দেখা দেখি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে ক্রেডিট কার্ড ও কনজুমার লোন দিয়ে ভবিষ্যত-আয়কে বর্তমানে খরচ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে, মানুষের ভোগ স্পৃহাকে উসকে দিচ্ছে। যখন কেউ নগদ টাকা দিয়ে বাজার করে তখন কেনার মধ্যে একটা নিয়ন্ত্রন থাকে, সে বুঝতে ও অনুভব করতে পারে কি পরিমাণ খরচ তার হচ্ছে, কত টাকা তাঁর পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এখানে একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারও কাজ করে। বিল পরিশোধ করার সময় একটা খোঁচা তাঁর মনে লাগে যে আহ এত টাকা খরচ হয়ে গেল। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কিছু কেনাকাটা করলে ঐ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটা ঘটে না। একটা স্বাক্ষর করলে সব চুকে যায়। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে তখন যখন পরিশোধের সময় এসে পড়ে। প্রতিমাসে সর্বনিম্ন পেমেন্ট করলে এক জীবনে শেষ হবার কথা নয়। আজীবন ঋণের জালে বন্দী হবার একটা ভাল ক্ষেত্র।
পশ্চিমা দেশগুলোতে এখন প্ল্যাস্টিক কার্ড ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তাঁরা এখান মেনে নিচ্ছে যে ঋণ করে  ভোগ বাড়ালে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে বাধ্য। একটা গবেষণায় দেখা গেছে আমেরিকার ৩৮.১ শতাংশ পরিবারের ক্রেডিট কার্ডের ঋণ আছে। তাঁদের গড় এই ঋণ ৫৭০০ ডলার। আর যে সব পরিবারের নিট সম্পদ শুন্য বা ঋণাত্মক তাঁদের গড় ক্রেডিট কার্ড ঋণ হচ্ছে ১০৩০৮ ডলার। অ্যামেরিকানদের মোট কন্সুমার লোণের বকেয়া ৩.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ক্যানাডিয়ানরা বছরে ৩০ হাজার কোটি ডলার খরচ করে ক্রেডিট কার্ডে। গড় একজন ক্যানাডিয়ানের ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ৮৬০০ ডলার যা ভারতীয়দের মাথাপিছু আয়ের পাঁচগুণেরও বেশী। তাঁদের যেসব ক্রেডিট কার্ড চালু আছে সেইসব কার্ডের বিপরীতে বার্ষিক খরচ হয় গড়ে ৯৭০০ ডলার। বর্তমানে তাঁদের সচল ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ৩১০ লাখেরও বেশী যাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ কার্ড হোল্ডার সঠিক সময়ে কার্ডের বকেয়া পরিশোধ করেননা অর্থাৎ তাঁদের নিয়মিত সুদসহ বকেয়া পরিশোধের সাথে সাথে পেনাল সুদ পরিশোধ করতে হয়। যারা ক্রেডিট কার্ড বিক্রি করেন তাঁদের প্রিয় এবং প্রিমিয়াম গ্রাহক হচ্ছে তাঁরা যারা সঠিক সময়ে দেনা পরিশোধ না করে বরং দু-পাঁচদিন পরে পরিশোধ করে।
ক্রেডিট কার্ডের ঋণে অভ্যস্থতা একটা পরিবারকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে নিপতিত করতে পারে বলা হয় যারা ক্রেডিট কার্ডের চক্করে পড়েন তারা এই দুষ্ট চক্র থেকে প্রবল মনবল ছাড়া বের হয়ে আসতে পারেন না। ছোট একটা হিসাব দেই ক্রাডিট কার্ডের বিষয়ে তাহলে বিষয়টার ঋণাত্মক দিকটা একটু আঁচ করা যাবেধরুন যদি কোন ব্যাক্তি ক্রেডিট কার্ড চার্জ করে পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ তুলে ব্যাংক/এটিএম থেকে, সুদ যদি হয় বাৎসরিক চব্বিশ শতাংশ, সে যদি মাসিক সর্বনিম্ন বকেয়াটা পরিশোধ করে নিয়মিতভাবে- ধরুন একশ টাকা (২ শতাংশ) তাহলে তার ক্রেডিট কার্ডের দেনা পরিশোধ করতে সময় লাগবে অন্তত ৩০ বছরএবং এই ৩০ বছরে সে ৫,০০০ টাকায় সুদ দেবে ৩৬,১০০ টাকা অর্থাৎ ঋণের ৭.২২ গুণ। ক্রেডিট কার্ডের ঋণে একবার যাকে স্পর্শ করেছে সেই স্বর্গীয় (?) স্পর্শ থেকে মুক্তি পাওয়া তার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব সময় এমনভাবে সামনের দিকে যাচ্ছে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া হয়ত চলা কঠিন হয়ে যাবে তাই এর ব্যবহারে সতর্ক না হতে পারলে আমরা ঋণের আবর্তে ঘুরপাক খাব, নিজেরা ঋণগ্রস্থ থাকব অর্থাৎ নিজে কষ্ট করে আয় করে ক্রেডিট কার্ড বিক্রেতাদের ধনী করবো।   

অতি খরুচে স্বভাব পরিহার করা এবং সেজন্য খরচকে, খরচের খাতকে চিহ্নিত করা খুবই জরুরীজীবন হচ্ছে অনেক বিকল্প পছন্দের সমাহার, যার যেটা পছন্দ সে সেটা নেবেযার যে পথ পছন্দ, সে সেই পথে পরিভ্রমণ করবেতবে বোধকরি সবাই একমত হবেন যে টাকার প্রাচুর্য এবং টাকার প্রভুত অভাব মানুষকে যতটা প্রভাবিত করতে পারে, তার সুখ-শান্তি-অসুখ-বিসুখে যতটা প্রভাব ফেলতে পারে অন্য কোন বস্তুগত জিনিস ততটা প্রভাবিত করতে পারেনাতাই টাকার শৃংখলা একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়

অনেকের ধারণা ধনী সবাই হতে পারেনা, তাদের মধ্যে ধনী হবার যোগ্যতা নেইএই কথাটার মধ্যে অসারতা বিদ্যমান, সবাই হয়তো একজীবনে তাদের নিজের মত করে ধনী হতে পারে না কিন্তু নিজের অর্জিত টাকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করে, সঠিক পথে বিনিয়োগ করে, আর্থিক জ্ঞান দ্বারা নিজের টাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করে এবং নিজের সঞ্চিত টাকাকে সম্পদে রুপান্তরিত করে যে কেউ সম্পদশালী বা ওয়েলদি হয়ে ওঠতে পারে সহজেতার জন্য কিছু নিয়ম মানতে হয়, নিজের লোভ ও ভয়কে নিয়ন্ত্রন করতে হয়, নিজের ভোগ স্পৃহাকে দমন করতে হয়, নিজের আয় ব্যয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে হয়, সম্পদ ও দায় কি বুঝতে হয়, সর্বপরী নিজের সাধ্যের মধ্যে চলতে হয়, সঞ্চয়ী মানসিকতা গড়ে তুলতে হয়
কোন কাজই কঠিন নয় যদি তাকে আমরা সহজ হিসাবে গ্রহণ করতে পারিমন আমাদের খুব অমূল্য একটা সম্পদএই মনকে নিয়ন্ত্রণ করে সময় ও উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে জীবন ও সম্পদমূখী হতে হয়তবেই জীবনকে দারিদ্রের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করা যায়
পরিশেষে ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শেষ করবো। আমার ব্যাক্তিগতভাবে তিনটা ক্রেডিট কার্ড ছিল। দেখেছি স্বপ্ন বা এগোরা বা অন্য কোন সুপার শপে ঢুকলে জিনিসপত্র কেনা যেন আর শেষ হতনা। তাছাড়া একটা কিছু কিনতে গিয়ে কিনে ফেলতাম তিন চারটা জিনিস। প্রতিমাসে দিতাম শুধু সর্বনিম্ন পেমেন্ট। একসময় দেখলাম ক্রেডিট কার্ডের ঋণের বোঝা এত ভারি হয়ে গেছে যে আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় ঋণের টাকার একটা অংশ শোধ করতে। দেখা গেল যতই শোধ করিনা কেন ঋণের পরিমাণ যেন কমে না। একদিন রাতে খুব চিন্তা করলাম। পরের দিন সকালে একটা কাঁচি নিলাম হাতে। একে একে কেটে ফেললাম দুটি ক্রেডিট কার্ড। ডেবিট কার্ডও কেটে ফেললাম। বাকী থাকল একটা ক্রেডিট কার্ড। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমার ভোগস্পৃহা বা কেনাকাটার ইচ্ছা কমতে শুরু করলো। এখন আমার একটা মাত্র ক্রেডিট কার্ড। সেটাও অনেকদিন হাত দেই না। পারলে অল্প করে হলেও শোধ করি। যে দুটো কার্ড নষ্ট করলাম তাদের ঋণ শোধ করলাম প্রথম পরে যেটা এখন আছে সেটার উপর কাজ শুরু।

আমার মনে হয় স্বল্প আয়ের লোকজনের উচিত যতদুর সম্ভব ক্রেডিট কার্ড নামক ঐ শক্তিশালী খরচাস্ত্র থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরতে রাখা। আপনি যদি ঋণ মুক্ত হতে পারেন তাহলে আপনার শান্তির ঘুমের হন্তারক হবার জন্য বিশেষ কাউ আর থাকবে না।   

সাইফুল হোসেন- কলাম লেখক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক    

ক্রেডিট কার্ড ভয়াবহ এক খরচাস্ত্র- এর ব্যবহারে সতর্কতা জরুরী   ক্রেডিট কার্ড ভয়াবহ এক খরচাস্ত্র- এর ব্যবহারে সতর্কতা জরুরী Reviewed by FinPowers.Com on July 14, 2017 Rating: 5

2 comments:

Powered by Blogger.