যে ১২ টি কারনে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করে ফেলি


যে ১২ টি কারনে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করে ফেলি



সবাই ভাবে আয় করি তো খরচ করার জন্য। আয় করার আর কি উদ্দেশ্য। কথাটির যৌক্তিকতা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আমাদের জীবনের ব্যাপ্তিকাল অতিমাত্রায় অল্প এই পৃথিবীতে। গোছাতে গোছাতে জীবন শেষ পর্যায়ে চলে আসে। তারপর ও মনে হয় কিছুই করা হয়ে উঠেনি, সব বাকী আছে। অনেকের ধারণা আমরা সবাই যেহেতু একটা সময় পৃথিবী থেকে হঠাৎ করে চলে যাবো তাহলে টাকা পয়সা ধন সম্পদ রেখে কি লাভ। যা আয় করবো তাই খরচ করবো। কথাটা তাদের জন্য ঠিক আছে তাদের মত করে। আমি উনাদের চিন্তার সাথে একটু নতুন কিছু সংযোজন করবো, তার বেশী কিছু নয়। জীবন আপনার, সেই জীবন আপনি কিভাবে যাপন করবেন তার স্বাধীনতা আপনার আছেআপনি যদি কোন আর্থিক লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে না যান তবে তার কারণে আপনার জীবনে আকস্মিকভাবে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যেতে পারে যার জন্য আপনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তখন কি হবে? আমরা জানি আল্লাহ বা ঈশ্বর আমাদের দেখবেন কিন্তু আল্লাহ আমাদের নিজেদের বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন নিজেদের ভালমন্দ বুঝার জন্য, স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছেন নিজেদের জন্য পরিকল্পনা  করার জন্য। তাই যদি আমরা  আমাদের আর্থিক ভিত্তি জোরদার করার জন্য প্রচেষ্টা না করি তবে তার ফলে যে ঘটনা বা দুর্ঘটনা জীবনে আসবে সেটা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের জীবনে যখন কোন দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ আপদ আসে এবং সেটাকে মোকাবেলা করতে না পারি তার প্রধান কারণ মুলত আর্থিক, সাথে অন্য কারনও থাকতে পারে। আপনার হাতে টাকা থাকা না থাকা আপনার আয়ের পরিমানের উপর নির্ভর করেনা বরং নির্ভর করে সেই অর্জিত টাকাকে সঠিকভাবে ব্যাবহার করতে পারা না পারার উপর তাই সে অজ্ঞতার কারণে হোক বা অন্য কোন কারনে হোক।
মজার বিষয় হচ্ছে যারা প্রয়োজনের তুলনায় বেশী খরচ করেন তাদের অনেকেই জানেনই না যে তারা সেটা করেন এবং এটাও জানেন না যে তারা কেন বেশী খরচ করেন
এটা জানা দরকার যে অতি খরুচে মনোভাব এবং অতি খরুচে স্বভাব মানুষ কে সঞ্চয় বিমুখ করে তোলে। সঞ্চয় কম হলে বা না হলে বিনিয়োগের জন্য টাকা আসবে কোথা থেকে। আর আপনার টাকা যদি কোথাও বিনিয়োজিত না হয় তবে তা বাড়বে কিভাবে? তাই অতি খরুচে স্বভাব মানুষকে দারিদ্রের নিগুড়ে বন্ধী রাখতে একটা বড় ভূমিকা রাখে।
আমরা নীচে দেখবো মানুষ কি কি কারণে অতি খরুচে হয়ে যায়। দেখবো কেন তারা খরচ করাকে এড়াতে পারেনা। অতি খরুচে বলতে বুঝাচ্ছি আয়ের সাথে সঙ্গতি না রেখে খরচ করা এবং নিডস এবং ওয়ান্টস মধ্যে পার্থক্য না করে ওয়ান্টস এর প্রতি মনোযোগী হয়ে অপ্রয়োজনীয় খরচ করা কে এবং নিজের কাছে টাকা না থাকলে ঋণ করে তাই সে ব্যাংক থেকে হোক, ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ করে হোক বা বাক্তিগত ঋণ করে হোক খরচ করাকে
কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে মানুষ বেশী খরচ করে সেটা নিয়ে আমার আগ্রহ দীর্ঘদিনের এ বিষয়ে আমি অনেকের সাথে কথা বলেছি, ধনী, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সব ধরণের লোকের সাথে আলোচনা থেকে অনেকগুলো তথ্য বেরিয়ে এসেছে যার একটা তালিকা আমি তৈরি করেছি সেই বিষয়গুলো আপনাদের সাথে আমি তুলে ধরছি

১) নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখা এবং আরও বৃদ্ধি করা

আমার ছোট মেয়ের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। যে গাড়ীতে চড়ে সে স্কুলে যায় সেটি একটা পুরনো মডেলের টয়োটা গাড়ী। তার এক সমবয়সী নতুন একটা গাড়ীতে চড়ে স্কুলে যায় আমার মেয়ে আমাকে জানিয়ে দিল সে আর ঐ গাড়ীতে করে স্কুলে যাবেনা কারন আমাদের গাড়ীর রঙ, শেপ তার ভাল লাগেনা স্কুলে অনেকের গাড়ী আমাদের গাড়ীর চেয়ে অনেক সুন্দর এসব কিছু দেখে তার পুরনো  মডেলের টয়োটা আর ভাল লাগেনা আমি খুব ভাল করে বুঝালাম তবু সে তৃপ্ত নয় আমার স্ত্রী কথাটা শুনে বলল ঠিকই আমাদের গাড়িটা একটু বেশী পুরনো হয়ে গেছে আমার প্রতিবেশীদের অনেকেই শুনেছে বিষয়টি তাদের কথা পারলে দেখেন, মেয়েটা একটা আবদার করেছে আমি বুঝিয়েছি আমার মেয়েকে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সেটা এখানকার আলোচ্য বিষয় নয়
এই যে অন্যের অবস্থান দেখে নিজের অবস্থান পরিবর্তনের প্রচেষ্টা- এটা এখন সমাজের সাধারন প্রবণতা যদি আমি আমার প্রতিবেশীর সাথে তাল মিলাতে না পারি, যদি তাদের মত জীবন যাপন করতে না পারি তবে আমার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, আমি তাদের তুলনায় সমাজে ছোট হয়ে যাবো এই যে অনুভূতি এটা এখনকার এই পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভোগবাদীতার এই যুগে খুব মহামারীর আকার ধারণ করেছে।
আমরা নিজেদের মত করে নিজেরা চালিত হতে পারিনা। অন্যরা আমাদেরকে কিভাবে দেখতে চায় আমরা নিজের নিজেদেরকে সেভাবে সাজাই। আমার কোন ড্রেস ভাল লাগছে সেটা খেয়াল না করে দেখি অন্যরা আমাকে ড্রেসটায় সুন্দর বলছে কিনা। আমরা প্রতিটি ব্যাপারে যেমনটি অনুভব করছি, আচরণ করছি, আমাদের প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরাও ঠিক তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে তেমনই আচরণ করছে। আর তার প্রভাব যেয়ে পড়ছে টাকা খরচের উপর। আপনি যা-ই করতে যান আপনার টাকা খরচ করতে হবে।

২) বিজ্ঞাপনের শক্তি

বিজ্ঞাপন অত্যন্ত শক্তিশালী প্রভাব ফেলে মানুষের মনে। আপনি যখন টেলিভিশন সেটের সামনে বসবেন পরিবারের সবার সাথে প্রতিদিন, দেখবেন কোন না কোন সদস্য কোন একটা কিছু কেনার আবদার করবে বিজ্ঞাপন দেখে, হয়ত তখনই অথবা পরে যেকোন এক সময়েজামা কাপড়, খাবার দাবার, খেলনা, বিভিন্ন ধরণের চকলেট, মেকআপ প্রসাধনী, রঙ ফর্সা করার ক্রিম থেকে এমন কোন জিনিস নেই যা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে উঠে আসেনা। ভাল করে খেয়াল করে দেখবেন ওগুলো অতি দরকারি কোন পণ্য নয়। ঐ দ্রব্যগুলো নিডস নয় বরং ওআন্টস এর মধ্যে পড়বে।
দেখবেন বিজ্ঞাপনের ভাষা কত চমৎকার যা আপনার প্রান কেড়ে নেবে কিন্তু তার বাস্তবতা অন্যরকম। বিজ্ঞাপনের ভাষা তৈরি করেন বিজ্ঞাপনের বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানধারী লোকজন। তারা জানেন মানুষের মনস্তত্ত্ব। তারা কখনো পণ্যটি পরখ করে তারপর বিজ্ঞাপন বানান না। আবার যারা বিজ্ঞাপনের মডেল হন তারা হয়ত জীবনে কোনদিন ঐ পণ্য ব্যাবহারই করেননি তারা টাকা পান আর আকর্ষণীয় চটকদার কথাবার্তা দিয়ে, নাচ গান দিয়ে একটা চিত্তাকর্ষক ফিল্ম বা বিজ্ঞাপন তৈরি করেন সুন্দর সুন্দর মডেল দের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তারাও এক একটা পণ্য।
এসব বিজ্ঞাপনে বলা হয় তুমি স্মার্ট হবে, রঙ ফর্সা হবে, দেখতে সুন্দর হবে, মোটা স্বাস্থ্য চিকন হবে, চিকন স্বাস্থ্য মোটা হবে, তাদের পণ্য আপনাকে অভিজাত বানাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিজ্ঞাপন চিত্তাকর্ষক করে বানানো হয় যেন সেটা বেশী দর্শকে দেখেন। একটা বিজ্ঞাপন হিট মানে ঐ পণ্যটাই হিট, পণ্যের গুনাগুন যাই হোক না কেন। আর আমরা বিজ্ঞাপনের ঐ মিথ্যাচারে প্রলুব্ধ হয়ে পণ্য ক্রয় করে এক ধরণের প্রতারনার শিকার হই (যদিও ঢালাওভাবে কথাটি ঠিক নয়)। এখন শুধু টিভি নয়, রেডিও, ম্যাগাজিন, পত্রিকা, বিলবোর্ড, ফ্ল্যাইয়ারস, ফেসবুক, টুইটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি নানা মাধ্যমে বিজ্ঞাপন চলছে বিভিন্ন আঙ্গিকে যার দ্বারা মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে অতি খরচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তার ব্যয় স্পৃহা, ভোগ স্পৃহা বাড়ছে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরচ।
আয় কি বাড়ছে আপনার? প্রশ্ন করেছেন নিজেকে একবারও? দেখবেন সারাদিন শুধু খরচের জন্য আয়োজন চারিদিকে। কখনো কি দেখেছেন আপনি আয় বাড়াবেন কিভাবে সেই বিজ্ঞাপন কেউ দিচ্ছে? দেখবেন না। কারন সবাই আপনাকে বেশী ভোগে উৎসাহ জোগাবে, আয় বাড়াতে উৎসাহ দেয়ার কেউ নেই। আমরা বইটিতে আপনাকে এমন একটি পথ পরিভ্রমন করাব যে পথে আপনি জানতে পারবেন চিনতে পারবেন কি আপনার জন্য সঠিক আর কি আপনার জন্য সঠিক নয়।  

৩) অনেক সময় এড়ানো যায় না

বাঙালীরা খুবই অতিথি পরায়ণ এটা সবাই জানেন। কেউ বাড়িতে বেড়াতে এলে বা কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে আমরা খালি হাতে এগুলো সারতে পারিনা। এটা আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের মন এগুলোকে এড়াতে দেয়নাতাছাড়া বন্ধুরা সবাই মিলে যখন একসাথে কোন দামী রেস্তরাঁতে যাই তখন ও নিজের পকেটে আগে হাত যায় এমনকি সামর্থ্য না থাকলেও। এখন সময় এমন জিনিসপত্রের দাম এত বেশী যে চার পাঁচ জন বন্ধু বান্ধব নিয়ে কোথাও খেতে গেলে তিন চার হাজার টাকার কমে শেষ করা যায়না। এই ভাবে যদি কেউ মাসে দুই তিন বার বাইরে বন্ধুবান্ধব নিয়ে খায় তার খরচ বাড়বেই যা সে তার বর্তমান আয় দিয়ে পোষাতে পারবে না। আমরা যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের এই সব দিক ভেবে দেখতে হবে। বাইরে বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত না করে বাসায় খাওয়ানো মন্দ নয় তাতে খরচ এক চতুর্থাংশ হবে। আর মনে রাখতে হবে যে সব বন্ধু বা আত্মীয় স্বজন আপনাকে বেশী খরচে প্ররোচিত করবে তারা আপনার প্রকৃত স্বজন নয়। তারা আপনাকে একটা প্রেশার কুকার বানিয়ে ছাড়বে।

৪) সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারা

অনেক মানুষ আছেন যারা খুব বড় ধরণের খরচ করতে অভ্যস্ত তারা অধিকাংশ সময় ভেবেই দেখেন না যে তাদের হাত দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে তাদের ধারণা দামী ওয়াইন, নামকরা মডেল বা দামী কোন শো উপভোগ করার পেছনে টাকা খরচ করাই হচ্ছে বেশী খরচ করা। আবার অনেক বেশী মাত্রায় ব্রান্ডেড কাপড় কেনা, খুবই আধুনিক মানের গাড়ী কেনা হচ্ছে শুধু বেশী খরচ করা। কিন্তু এর বাইরে বিভিন্নভাবে তাঁরা অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ করে বসেন যেটা না করলেও চলত। তাঁরা সেটা যত্নের সাথে খেয়াল করেন না। দেখা যায় বাসার ভিতরের সাজসজ্জা, এমনকি বাথরুমের ভিতরের অলংকরনে তাঁরা এত খরচ করছেন যেটা চোখের দেখা ছাড়া বাড়তি কোন উপযোগ সংযোজন করছে না। ফলে টাকাগুলো অপচয় হচ্ছে।
দেখা যায় এইসব বড় খরুচে মানুষ গুলোর টাকার সরবরাহ বেশী থাকে। সেই টাকার উৎস ব্যাংক ঋণ হতে পারে, হতে পারে নিজের অর্জিত বা সঞ্চিত টাকা বা উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত টাকা বা অন্য কোন ভাবে গচ্ছিত টাকা। যদি তাঁরা টাকার আন্তঃপ্রবাহ বা বহিঃপ্রবাহ ভালভাবে না নজরে আনেন তবে একসময় তাদের এই অতি খরুচে স্বভাব তাদের জন্য বিপদের কারন হতে পারে। এমন নজিরের অভাব নেই যে আজ অনেক টাকা, কলকারখানার মালিক আবার অল্প কিছুদিন পর সব হারিয়ে নিঃস্ব। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই সব বড় মাপের (!) মানুষগুলো তাদের সম্পদ ও দায়ের চিত্র সম্পর্কে সচেতন এবং ক্ষেত্র বিশেষে অবগত নন তাই এদের বিপদ আসলে সেটা রক্ষা করা কঠিন বা কখনো কখনো অসম্ভভ হয়ে ওঠে
আপনার টাকার উৎস আছে মানলাম তাই বলে অপচয় কেন, টাকা দিয়ে ভাল কাজ করুন বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেটের নীতি আপনিও অনুসরণ করুন না কেন উনি যদি তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে ১২৫০ স্কয়ার ফিটের বাড়িতে থাকতে পারেন, নিজের অধিকারে অল্প সম্পদ রেখে বাকিটা দান করতে পারেন তবে আপনিও তো অপচয় না করে সেরকম কিছু ভাবতে পারেন আপনার অর্জিত সম্পদে কি বঞ্চিতদের অধিকার নেই??

৫) নিজেকে পুরস্কৃত করা  
 
অনেক মানুষ আছেন যারা মনে করেন তাঁরা যেহেতু জীবনে খুব কষ্ট করে একটা জায়গায় পৌঁছেছেন তাদের নিজেদের অধিকার আছে কিছু বাড়তি খরচ করা। তাঁরা তো সারাদিন সারারাত পরিবার পরিজনের জন্য আয় রোজগার করার জন্য সময় ব্যয় করেন তাহলে তাঁরা নিজেদেরকে একটু পুরস্কৃত করবেন না কেন। কথাটার মধ্যে যে যুক্তি নেই তা নয়। তবে নিজেকে এই পুরস্কৃত করার মানুসিক ইচ্ছা যদি অল্পতে তুষ্ট হয় তাতে অসুবিধার কিছু নেই কিন্তু যদি এমন হয় যে এই পুরস্কার দামী ওয়াইন, নারী, প্রায়ই দামী দামী রেস্তোরাঁতে খাওয়া দাওয়া, ড্রাগ নেয়া ইত্যাদিতে গড়াচ্ছে তাহলে চিন্তার বিষয় আছে বৈকি। নিজেকে একটু সামলে চলতে হবে না হলে নিজের কষ্টের উপার্জন নিজের জন্যই ক্ষতির কারন হয়ে দেখা দেবে যা একসময় নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে।  

৬) ঋণ প্রাপ্তির সহজলভ্যতা

যেকোনো সময়ের চেয়ে ঋণ প্রাপ্তি এখন সহজব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আপনাকে ঋণ নেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করছে। ধারণাটা এদেশে কিছুটা নতুন হলেও পশ্চিমে এটা পুরাতন। আপনি এখন কোন কিছু কিনবেন, টাকা শোধ করবেন কিস্তিতে, কিছু কিছু পণ্য ক্রয়ের জন্য আপনাকে সুদ দিতে হবে না। এই ধরণের নানা অফার থাকে যা একজন ক্রেতার মনে ভোগ স্পৃহা বাড়িয়ে তোলেআবার তার প্রয়োজনও মেটে। খারাপ তো কিছু না। ঋণ যত সহজলভ্য হয় মানুষের ভোগ প্রবণতা তত বেড়ে যায়। আর ভোগ প্রবণতা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে খরচ।
যেকোন ভাবে মানুষের হাতে তারল্য প্রবাহ যখন বাড়ে তখন তার জিনিসপত্র কেনা কাটা বা অন্যান্য খরচের জন্য মনে একটা প্রনোদনার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া পরিবারের চাপও বাড়ে যা খরচকে উসকে দেয়। এই ক্ষেত্রে নিজেকে সামলিয়ে বা বাঁচিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। ফলে খরচ বাড়ে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে ঋণ। এভাবে চললে একসময় যেয়ে আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। জীবন যাপনের ধরণ ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকে। একসময় খারাপ সময় চলে আসে। আর এ অবস্থায় যদি পরিবারে কোন বিপদ আসে, চাকরী নিয়ে কোন সঙ্কট হয় বা অন্য যেকোন কারণে আয়ের উপর কোন বাঁধা আসে তখন জীবন সত্যি দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। পরিবার শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই সতর্ক ভাবে জীবনের পথ চলা দরকার। ঋণ করে ঘী খাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা পরিবার ও সমাজের জন্য উপকারী।

৭)  টাকা খরচ করাকে ফান বা অযাচিত আনন্দের উৎস হিসেবে দেখা 
  
আনন্দ পিপাসু অনেক মানুষ টাকা খরচ করাকে এক ধরণের অযাচিত আনন্দের উৎস হিসেবে দেখে থাকেন। প্রথম গাড়ী কেনা এমন কি দামী দোকানে কিছু কেনাকাটা করা এক ধরণের উচ্ছ্বাসের বা উত্তেজনার সৃষ্টি করে। কারো আবার এমনও হয় যে মন একটু খারাপ লাগছে, কিছু কেনা কাটা করলে, একটু কফি শপে গিয়ে ব্রান্ডেড কফি পান করলে ভাল লাগে। সুতরাং একটু খারাপ লাগলে এই ধরণের মানুষেরা খরচ করে মনের প্রশান্তি ফিরিয়ে আনতে চান। প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ মানুষ মনের শান্তি বা আনন্দ আনার জন্য টাকা খরচ করেন কিন্তু যে সুখের জন্য বা প্রশান্তির জন্য সেটা করেন সেই সুখ বা প্রশান্তি পান না কারন তাঁরা জানেন না শুধু টাকা খরচ করে মনের আঁধার দূর করা যায়না। মনের শান্তি আনার জন্য মনকে তৈরি করতে হয়। অনেক খরচ করার পরেও তাই তাদের মন শান্ত হয়না, মনে আলোর প্রজ্বলন ঘটেনা, তাদেরকে স্থির মনে হয় না।
আবার অন্যদিকে গরীব হবার মধ্যেও কোন শান্তি আছে বলে মনে হয়না। তাই যাদের এখন টাকা হাতে আছে তাঁরা যদি শুধু মনের শান্তির বা আনন্দের জন্য টাকা খরচ করেন তবে তাঁরা খুব শিঘ্রই গরীব হয়ে যাবেন। এখন যারা অপ্রয়োজনে টাকা খরচ করছেন কিছুদিন পর তাঁরা প্রয়োজনে খরচ করার টাকা পাবেন না কারণ অপচয় তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে খাঁদের কিনারে দাড় করিয়ে দেবে তা সে আজ হোক আর কাল- শুধু সময়ের অপেক্ষা। 
সত্যি কথা বলতে কি পৃথিবীতে যে সব জিনিস আমাদের মনের আঁধার ঘুচিয়ে দিতে পারে, আমাদের মনে শান্তির কপোত উড়াতে পারে সেই সব জিনিসের জন্য পয়সা খরচ করতে হয়না। যেমন একটা শিশুর মনোমুগ্ধকর হাসি, সকালে সূর্যের আলো, ফুলের মনমাতানো রুপ, সূর্যাস্তের দৃশ্য, প্রিয় বা প্রিয়ার আন্তরিক আহ্বান, বন্ধুর সাথে ফোনালাপ ইত্যাদি।
‘পারসোন্যাল ফাইন্যান্স ফর ড্যামিস’- বইয়ের লেখক এরিক টাইসন খুব সুন্দর করে  একটা কথা বলেছেন যা সবার ভাল লাগার মত। তিনি বলেছেন, আপনাকে কে বলেছে যে আপনার সমস্ত টাকা খরচ করাই হচ্ছে আনন্দ পাওয়ার একমাত্র উপায়? আপনাকে আবার নির্মল আনন্দ আর কদাকার আনন্দের পার্থক্য করতে হবে নচেৎ ক্ষণিক আনন্দ আপনাকে স্থায়ী দুঃখের মধ্যে নিমজ্জিত করতে পারে।

৮)  টাকা খরচ করতে পারা এক ধরণের শক্তি বা আভিজাত্য প্রদর্শন

অনেকের মনের অন্তঃপুরে একটা লুকানো ধারণা আছে যে টাকা খরচ করা এক ধরণের শক্তি বা আভিজাত্য কে প্রকাশ করে। টাকা খরচ করলে সমাজে তাঁরা একটা উঁচু জায়গায় উঁচু আসনে বসবেন। আশেপাশের লোকজন তাদেরকে ক্ষমতাশালী এবং অভিজাত হিসেবে বিবেচনা করবেন। এই অসত্য ধারণা তাদেরকে খরচে উৎসাহিত করে। তাঁরা পকেটের নগদ টাকা হোক আর ঋণের টাকা হোক খরচ করেন এবং তার ফলে একসময় তাঁরা অর্থ কষ্টে ভোগেন, নিজেদের জীবনকে অনিরাপদ করে তোলেন। টাকা বেশী খরচ করতে পারা বা করচ করে অতিরঞ্জন করা কে আর যাই হোক আভিজাত্য বলা যায়না কোনভাবে। 
  
৯) সহকর্মী, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবদের প্রভাব

আমার পাঁচ বছরের মেয়ে পারিসা একদিন স্কুল থেকে এসে খুব কান্না কাটি শুরু করে দিল। কারন জানতে চাইলাম। শুনলাম তার ক্লাসমেটরা ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে ঘুরতে গিয়েছে কিন্তু আমরা কেন যাইনি সেই কারণে সে কাঁদছে। কয়দিন আগে তার মামা একটা গাড়ী কিনেছে সেটা স্টার্ট দিতে চাবি লাগেনা। পারিসা গাড়ীটিতে চড়ার পর থেকে যতবার আমার সাথে আমার পুরনো গাড়ীটিতে উঠেছে, আমাকে বার বার বলেছে তার মামার মত একটা নতুন গাড়ী কিনতে। ঐ গাড়ী তার ভাল লাগে। আমার মনে হয়েছে যদি মেয়ের আবদার রাখি তবে কেমন হয়? যদি বিদেশে ছুটি কাটাতে যেতাম তাহলে কেমন হত। আমি চিন্তা করেছি আমার অত টাকা খরচ করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। তাই ঐ খরচ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। এটা এক ধরণের মানসিক চাপ। এই চাপ সবাই সহ্য করতে পারেনা। আপনার বন্ধু একটা ভাল এ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে আপনার পরিবার থেকে, আপনার নিজের মন থেকে একটা চাপ তৈরি হতে পারে, আপনার সহকর্মী একটা ভাল গাড়ী কিনেছে আপনারও কিনতে ইচ্ছে হতে পারে এই সব ব্যাপারে সবাই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। কারো বাড়ির আসবাবপত্র, কারো বাড়ির সাজসজ্জা দেখে নিজের জন্যও কিনতে ইচ্ছে করতে পারে যা খরচ কে উস্কে দেয়। এই ধরণের খরচ অনেক ক্ষেত্রেই বাহুল্য হয়। এই খরচ বিনিময়ে ভাল কিছুর পরিবর্তে খারাপ কিছুই বয়ে আনে। আপনার টাকা আপনি খরচ করবেন, ভাল কথা কিন্তু একটু চিন্তা করে খরচটা করুন তাতে অন্যের মঙ্গল নয় আপনারই মঙ্গল হবে। 

১০) আমাদের বসবাস টেকনোলজি নির্ভর দুনিয়ায়

কয়েক মাস আগে আমার স্ত্রী বাইরে থেকে ফিরেছে খুব মন খারাপ করে। চোখ দিয়ে অশ্রু পড়ে পড়ে অবস্থা। কারন কি জানতে চাইলাম। শুনলাম উনার মোবাইল সেটটা চুরি হয়ে গেছে। সেটটা কেনা হয়েছিল মাস পাঁচেক আগে। তাই মনটা আমার ও খারাপ হল। তার পরের দিনই আর একটা নতুন মোবাইল কিনতে হল। যদিও সেটার জন্য আমার কোন পূর্বপ্রস্তুতি ছিলনা, তবুও।  
আমরা এখন এমন এক প্রযুক্তি নির্ভর যুগে বসবাস করছি যে একদিন না খেয়ে থাকা যাবে কিন্তু মোবাইল, টিভি, কম্পিউটার ছাড়া এক মুহুর্ত নয়। এইসব প্রযুক্তি আমাদের কার কতটুকু উপকার করছে সেটা বের করতে হলে গবেষণার প্রয়োজন কিন্তু খরচ যে পরিমাণ বাড়িয়েছে সেটাতে বোধকরি সবারই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
বাজারে নতুন মডেলের মোবাইল, আইফোন, টিভি, ল্যাপটপ, মিউজিক সিস্টেম এলে অনেক মানুষ আছেন যারা সঙ্গে সঙ্গে সেই নতুনের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোতে ব্যস্তআর এইসব জিনিসের দাম অনেক বেশী। অল্প আয়ের মানুষের পক্ষে এর সাথে তাল মিলানো অতি কষ্টকর। একটা মডেল পরিবর্তন হলে সুবিধার বেশী পরিবর্তন হয়না কিন্তু ভোক্তার খরচের পরিমাণ অনেক বাড়ে। যারা স্মার্ট ক্রেতা তাঁরা অপেক্ষা করে কখন দাম কমবে আর যারা একটু বেহিসেবী তাঁরা আগ পিছ চিন্তা না করেই সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে অনেক টাকা তাদের পকেট থেকে বেরিয়ে যায়, ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়।  
১১)  আমাদের খরচের কোন হিসাব রাখিনা  

আমেরিকাতে সম্প্রতি একটা ব্যাংকের জরিপে উঠে এসেছে যে তাদের প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবার প্রতিমাসে খরচের কোন বাজেট করে না ফলে যে খরচ তাঁরা করে তার কোন হিসাব তাদের কাছে থাকেনা। তাদের জানা থাকেনা কি পরিমাণ টাকা তাঁরা খাবারের পেছনে খরচ করছে, কি পরিমাণ টাকা তাঁরা কাপড়ের পেছনে খরচ করছে আবার কি পরিমাণই বা তাঁরা অন্যান্য বিষয়ে খরচ করছে। যখন কোন বাজেট থাকেনা, খরচ কি খাতে কি হচ্ছে তার কোন ধরাবাঁধা হিসেব থাকেনা। এই অবস্থায় আপনি টাকাকে নিয়ন্ত্রন করেন না বরং টাকাই আপনাকে নিয়ন্ত্রন করে। আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এটা একটা বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।

১২) আমরা ছোট ছোট খরচকে গুরুত্ব কম দেই

আমরা সবসময় বড় বড় খরচ গুলো গুরুত্ব দেই কিন্তু ছোট ছোট খরচ গুলো তেমন আমলে নেই না বাচ্চাদের জন্য চকলেট, আইসক্রিম, কোক, বিস্কিট, খেলনা, বন্ধুদের সাথে বসে কফি পান করা ইত্যাদি ছোট খরচ মনে হয় কিন্তু যদি আপনি এই সব ছোট খরচের দিকে নজর ফেরান তবে অবাক হয়ে যাবেন একমাস আপনি এই ছোট খরচের হিসেব যদি রাখেন দেখবেন এটার পরিমাণ মাসিক অন্যান্য খরচের চেয়ে কম নয় দিন যদি গড়ে ২০০ টাকা করে ছোট খরচ হয় তবে মাসে হবে ছয় হাজার টাকা এই খরচের পুরোটা হয়ত আপনি বাদ দিতে পারবেন না তবে একটু যত্নশীল হলে এর একটা বড় অংশ বাদ দেয়া সম্ভব সেই অংশ যদি তিন হাজার টাকাও হয় তবে তা দিয়ে আপনি অনায়াসে ১০০০ টাকার তিনটা সঞ্চয় স্কিম চালাতে পারেন। যদিও আপাতত দৃষ্টিতে এই পরিমাণটা ছোট মনে হয় তবু আপনি হিসেব করে দেখেন এটা মোটেও ছোট কোন পরিমাণ নয়। বছরে আপনি ছত্রিশ হাজার টাকা জমাতে পারেন এর সাথে সুদ বা লভ্যাংশতো আছেই। আসলে কোন ছোট পরিমাণ বা বিষয় ছোট নয়। সব বড় কিছু কিন্তু ছোট কিছুর যোগফল।
আমাদের প্রত্যেকের উচিত ছোট বড় খরচ লিখে রাখা এবং সপ্তাহান্তে বা মাস শেষে ওটা নিয়ে পর্যালোচনা করা যদি পরিবারের প্রত্যেকে এই কাজটা করেন তবে ঐ পরিবার আর যাই হোক অর্থের অপচয় করবে না এবং আর্থিক কষ্টে ভুগবে না আয়ের পথ কারো অগণিত নয় আর সেজন্য খরচ কোন পথে হচ্ছে তা সবার নজরে আনা উচিত তাতে পরিবার যেমন উপকৃত হবে, পরিবারের সব সদস্য তেমনি আর্থিক ব্যাপারে সচেতন হবেন বিশেষ করে পরিবারের সন্তানেরা বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে টাকা পয়সা নিয়ে বিপাকে পড়বে না টাকা আয় করা যত না শক্ত, অর্জিত টাকা সঠিকভাবে, সঠিক রাস্তায় খরচ করতে পারা এবং সেটাকে ব্যবহার করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া তার চেয়েও কঠিন

আমার এক সহকর্মী একদিন একটা কথা বলেছিল যা আমার মনে গেঁথে আছে। তার কথা ছিল সারাদিন আমরা যত বিজ্ঞাপন দেখি, যত দিকে আমাদের চোখ যায় সবকিছু আমাদের খরচকে উস্কে দেয়ার জন্য, আয় বাড়ানোর কোন বিজ্ঞাপন আমাদের চোখে পড়ে না। কথাটি অতি সত্য। সবাই শুধু পথ দেখায় কিভাবে খরচ করতে হবে, কিভাবে টাকা হাত থেকে বের করে দিতে হবে। কেউ বিজ্ঞাপন দিয়ে বলে না আপনি কিভাবে আয়কে বৃদ্ধি করবেন। তাই এই দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে আর সেজন্য আপনাকে আর্থিক জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। আপনার টাকা আপনাকে পাহারা দিতে হবে। কেউ আপনার টাকার যত্ন নিতে পারবে না যতটা আপনি পারবেন কারন ঐ টাকা আপনার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জন করা, অনেক পরিশ্রমের ফল ওটি। 

- সাইফুল হোসেন 
যে ১২ টি কারনে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করে ফেলি যে ১২ টি কারনে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করে ফেলি Reviewed by FinPowers.Com on October 01, 2017 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.