ভয় ও লোভ; শেয়ার বাজারের দুই বিনাশী শত্রুঃ সতর্ক হউন।



-    


      - সাইফুল হোসেন 

শেয়ারবাজার নিয়ে লিখতে গেলে আমার ১৯৯৬ এর কথা মনে পড়ে একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শুরু করি তখন আমি একটা ব্যাংকের সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছি শেয়ার বাজার নিয়ে তখন এত মাতামাতি যে মানুষজন সব বাজারঘাট বাদ দিয়ে শেয়ার বাজার নিয়ে ব্যস্ত আমার একজন শ্যালক তাঁর বাবার কাছ থেকে একপ্রকার জোর করে কিছু টাকা নিয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলো ছয় হাজার টাকা কয়েকদিনেই বারো হাজার টাকা হয়ে গেল তাঁর উদ্দীপনা দেখে কে আমার কাছে ঘুর ঘুর করে একদিন এসে প্রস্তাব দিল মাত্র বারো হাজার টাকা দিন মাত্র এক সপ্তাহ পরে আমাকে সে বিশ হাজার টাকা দিবে বাড়তি যদি কোন টাকা থাকে সেটার দাবী আমি করতে পারবো না আমি রাজী হলাম শর্ত দিলাম যদি লোকসান হয় তবে অন্তত আমার মুল টাকাটা ফেরত দিতে হবে সে রাজী হল উল্লেখ্য যে তখন শেয়ার ছিল কাগুজে ইলেকট্রনিক শেয়ার তখন চালু হয়নি তাছাড়া তখন কার্ব মার্কেট চালু ছিল রাস্তায় দাঁড়িয়েও শেয়ার কেনাবেচা হত পরে কোম্পানি থেকে মালিকানা বদল করা যেত 
যাহোক, আমি তাকে বারো হাজার টাকা দিলাম সে দ্রুত একটা জুতা কোম্পানির কাগুজে শেয়ার কিনল রাস্তা থেকে দশ বারো দিন পর তার দাম সত্যি বেড়ে গেল সে দৌড় দিল সেগুলো বিক্রির জন্য আমি খুব খুশী মনে বসে আছি সে আজ আমার টাকা ফেরত দিবে লাভসহ পরের দিন সে আমার অফিসে এসে আমার সামনের চেয়ারে খুব মন খারাপ করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ আমি কারণ বুঝলাম না জিজ্ঞেস করতেই খুব মন খারাপ করা একটা খবর শুনলাম উনি যে শেয়ারগুলো কিনেছিলেন সেগুলো জাল শেয়ার ছিল সে বিক্রি করতে পারেনি আমার মূলধন হারিয়ে গেল সম্পর্কে শ্যালক, কিছু বলতে পারলাম না যদিও শর্ত দেয়া ছিল এখানে আবেগের চেয়ে লোভটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল তাই সাতপাঁচ না ভেবে আমরা ঐ শেয়ার ব্যবসা করতে গিয়েছিলাম আমি নিজে কিনলে সতর্ক থাকতাম, রাস্তা থেকে কিনতাম না উল্লেখ্য আমার ঐ প্রিয় শ্যালক পরবর্তীতে ২০১০ সালের শেয়ার বাজারে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর যে পেনশানের টাকা পেয়েছিল পরিবার তার পুরোটা শেষ করেছে ঐ শেয়ার বাজারে
আমি বলেছি সে পুরোটা শেষ করেছিল শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে আসলে তো পুরোটা শেষ করা কঠিন কারণ যেসব কোম্পানির শেয়ার সে কিনেছিল সেইসব কোম্পানিতো উৎপাদন বন্ধ করে দেয়নি, সেসব কোম্পানি আগের মতই চলছে তবে আমার শ্যালকের টাকাটা পুরো নষ্ট হল কীভাবে? ঘটনাটা ২০১০ সালের শেয়ার বাজার যখন ষাঁড়ের মত দৌড়াচ্চে যাকে আমরা বুল মার্কেট বলি দেশের সবপ্রান্তের মানুষ যখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে শেয়ার বাজারে আজ কিনলেই কাল লাভ যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য; অনেক উচ্চসুদে ঋণ করেও অনেকে দৌড় দিয়েছে সেখানে অনেক লাভ হস্তগত করার জন্য, বুঝে না বুঝে সে শেয়ার কেনার সময় ১:১ ঋণ করেছে ব্রকারেজ হাউজ থেকে; মানে নিজের ১০০ টাকা হলে ঋণ নিয়েছে ১০০ টাকা বিপত্তিটা সেখানে নিজের ১০০ টাকার কোন সুদ দিতে হয়না কিন্তু ব্রকারেজ হাউজ থেকে ঋণ কৃত ১০০ টাকার বিপরীতে মাসে সুদ দিতে হয় ১৪-১৫ শতাংশ, তাও আবার চক্রবৃদ্ধি হারে দেখা গেছে ২০০ টাকা দিয়ে শেয়ার কিনেছে ৪ টি; প্রত্যেকটি শেয়ারের দাম ৫০ টাকা যদি পরের সপ্তাহে দাম বেড়ে ৩০০ টাকা হয় আর শেয়ার ধারক বিক্রি করে দেন তাহলে লাভ থাকে ১০০ টাকার কিছু কম কারণ ব্রকারেজ হাউজ কমিশন বাবদ কিছু টাকা কাটবে আমার আত্মীয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল শেয়ারের দাম বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছিল তার আশা ছিল ৮০০ টাকা হলে বিক্রি করবে ৪০০ টাকা হবার পরে মার্কেট কমতে শুরু করে একসময় কমতে কমতে ৩০০ তাকায় আসে; প্রত্যাশা আবার বাড়বে তারপর কমে ২০০ টাকা, পরে ১৫০ টাকা ,পরে ১০০ টাকা, পরে ৭৫ টাকা, পরে ৫০ টাকা এখন দেখুন শেয়ারের দাম মাত্র ৫০ টাকা, অন্যদিকে ঋণ সুদসহ ১২০ টাকা অর্থাৎ শেয়ার বিক্রি করে দিলে ঋণ সমন্বয় হবে ৫০ টাকার কিছু কম কারণ কমিশন বাদ যাবে তাহলে নীট ঋণ থাকবে কত? ধরুন ৭১ টাকা (৪৯-১২০) শেয়ার পুরোটা বিক্রি করলেও ঋণ বাবদ পকেট থেকে দিতে হবে ৭১ টাকা দেরি করলে আর শেয়ারের দাম না বাড়লে প্রতিদিন ১৪-১৫ শতাংশ হারে সুদ যোগ হবে ঋণের ফলে ৭১ টাকা প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়বে একসময়য় একশ একাত্তরে যাবে; গেছেও তাই ওদিকে ব্রকারেজ হাউজের উচিত ছিল যখন ঋণ সমন্বয় করা যেত শেয়ার বিক্রি করে তখন সেটা করা কিন্তু তারাও সেটা করেনি পরে তারাও আটকে গেছে আমার আত্মীয় বাবার পেনশনের টাকাটা হারিয়েছে সাথে ঋণের বোঝা তার মাথার উপর যদি সে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিত তাহলে এমন হতো না ভেবে দেখুন বাবার পেনশনের টাকায় কতজনের অধিকার? তাহলে পারিবারিক সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে যেয়ে ঠ্যাকার কথা
 শেয়ার বাজার মূলত দুই ধরনের আবেগ দ্বারা চালিতঃ ভয় এবং লোভ বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে এই দুই আবেগ এত বেশী কার্যকর যা একটু নজর দিলেই বুঝা যায় আমরা খুব সাহসী জাতি তার প্রমান অনেকবার দিয়েছি কিন্তু শেয়ার বাজারের ক্ষেত্রে এসে দেখি আমরা খুব ভীতু ভয় নামক এই ধ্বংসকারী ঋণাত্মক আবেগ আমাদেরকে খুব অল্পতেই আক্রান্ত করে কে কি বলল তা শুনেই আমরা শেয়ার বিক্রি করা শুরু করে দিলাম, কে কি গুজব ছড়াল আমরা হাতে থাকা সব শেয়ার একেবারে বিক্রি করে হাত খালি করে ফেললাম, অর্থমন্ত্রী বললেন শেয়ার বাজার ভাল হবে সবাই লাইন ধরে শেয়ার কিনলাম, পরের দিন গভর্নর বললেন সামনে সঙ্কোচনমূলক আর্থিক নীতি ঘোষণা করা হবে, ঋণ প্রবাহ কমে যাবে সাথে সাথে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করলাম দল বেঁধে; কি দারুন বোকামি যারা বুদ্ধিমান তারা আপনার শেয়ার কমদামে কিনে নিচ্ছেন আপনি লোকসান করছেন নিজের ভয়ের কারণে, দোষ দিচ্ছেন অন্যের, দোষ দিচ্ছেন সরকারের কেন? আপনি খেয়াল করে দেখুন কিছুদিন পর আবার শেয়ার বাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে লোকসান কে করছে, আপনি কথায় বলে শেয়ার বাজারে নব্বই ভাগ লোক লোকসান করে আর মাত্র পাঁচ ভাগ লোক লাভ করে আপনি ভয় পেয়ে শেয়ার বেচবেন না, তাহলে আপনি ঐ পাঁচ ভাগের দলভুক্ত হবে দুরভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমরা অধিকাংশ লোক শুধু ভয়ের কারণে এবং অবশ্যই জ্ঞান ও ধৈর্যের অভাবের কারণে নব্বই শতাংশ বিনিয়োগকারীর দলভুক্ত হয়ে পড়ি। 
আর একটি আবেগ হচ্ছে লোভযাআমাদেরকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয় অনবরত। আমরা একটা শেয়ারে কত লাভ করতে চাই? ১০ শতাংশ, ২০ শতাংশ, ২৫ শতাংশ? যারা ট্রেড করেন বা স্বল্প সময়ের জন্য বিনিয়োগ করেন তাদেরকে বলছি। যদি ১০০ টাকার শেয়ার ১১০-১১৫ টাকা হয় তখন আপনার শেয়ার ছেড়ে দিন,(যদি আপনি দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করেন তবে আপনার কথা ভিন্ন)  অপেক্ষা করুন আর একটি ভাল শেয়ার খুঁজে বের করুন, তারপর তাতে বিনিয়োগ করুন। আপনি যদি মনে করেন আপনার শেয়ারের দাম প্রতিদিন বাড়বে, একমাসে বা এক বছরে দ্বিগুণ হবে তবে আপনি অতিশয় লোভী ব্যক্তি। লোভকে দমিয়ে রাখুন। আমার আত্মীয় যখন ২০০ টাকা দিয়ে কেনা শেয়ারের দাম ৩০০, পরে ৪০০ টাকা হয়েছিল তখন যেকোন সময় তা বিক্রি করে দিতে পারত কিন্তু লোভ তাকে বারন করেছিল। এই লোভের লাগাম টেনে ধরা খুব জরুরী।
বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেট শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের একটা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন আপনি ভয় করুন যখন অন্যরা লোভ করে, আর লোভ করুন যখন অন্যরা ভয় করেঅন্যরা যখন বেশী লাভের আশায় শেয়ার ধরে রাখে তখন আপনি শেয়ার বিক্রি করুন, আবার অন্যরা যখন ভয় পেয়ে শেয়ার বিক্রি করে তখন আপনি লোভ করে শেয়ার কিনুন। কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি বুঝতে হলে শেয়ার বাজার সম্পর্কে পড়াশুনা করতে হবে, বুঝতে হবে। আমার দুই দশকের অভিজ্ঞতা বলে শেয়ার বাজার একটা ঘুরন্ত চাকার মত যা কখনো এক জায়গায় থেমে থাকেনা। সর্বনিন্মে নেমে তা আবার উপরে ওঠে। আপনাকে সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকতে হবে কখন আপনি শেয়ার কিনবেন, কোন শেয়ার কিনবেন আর কখন তা বিক্রি করবেন। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কিন্তু আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি একটু লোভ থাকা দরকার না হলে মানুষ বড় হতে পারে না। তবে লোভের মাত্রা যদি সীমা ছাড়িয়ে যায় তবে ভিন্ন কথা।
ইদানিং কিছু কিছু ফেসবুক সাইটে অনেক বিনিয়োগকারী দেখি হট আইটেমের খোঁজ করেন। কেউ কেউ বলেন আমাকে ইনবক্স করুন যদি হট আইটেম চান যেটার দাম কালকেই বাড়বে। এইভাবে অনেকে আইটেম খোঁজার রোগে আক্রান্ত। আরে বাবা, শেয়ার বাজার কোন মূর্খের বাজার নয়, এখানে বিনিয়োগ করা খুব সহজ কোন কাজ নয়, অনেক লেখাপড়া করে এখানে আসা উচিত। দেখা দরকার, বুঝা দরকার কোন শেয়ার আপনার কেনা উচিত। এমন শেয়ার কিনুন যে শেয়ারের দাম থাকবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পুড়ে গেলেও বা বন্ধ হয়ে গেলেও। কিন্তু সেটা তো আমরা করবো না। আমরা অন্যের কাছে আইটেম চাইব, কারা গেম করছে তাদের খুঁজে বের করবো তারপর সেইসব বুদ্ধিমান মহারতিদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ধরা খাব, আর দোষ দেব দেশের, সরকারের, অর্থমন্ত্রীর, গভর্নরের। নিজে প্রশিক্ষিত হন, নিজের শিক্ষা, মেধা মনন, চিন্তা পড়াশুনা কাজে লাগান। ভয় আর লোভ কে ঠিকমত নিয়ন্ত্রন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিন, আপনি শেয়ার বাজার থেকে লাভ করতে পারবেন। অন্যরা পারলে কেন আপনি নয়। নিজে তৈরি হন, এটা অন্যের উপর নির্ভর করে কাজ করার জায়গা নয়, গুজবে কান দিয়ে কাজ করার জায়গা নয়।  


সাইফুল হোসেন- লেখক, কলামিস্ট ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক   



ভয় ও লোভ; শেয়ার বাজারের দুই বিনাশী শত্রুঃ সতর্ক হউন। ভয় ও লোভ; শেয়ার বাজারের দুই বিনাশী শত্রুঃ সতর্ক হউন। Reviewed by FinPowers.Com on February 02, 2018 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.