-সাইফুল হোসেন
রাজনীতির সাথে টাকার একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। পৃথিবীতে যত শক্তি আছে টাকা তার মধ্যে অন্যতম, এটা রাজনীতির চেয়েও শক্তিশালী, পেট্রোলের চেয়েও দাহ্য, নারীর চেয়েও লাবণ্যময়ী এবং ভায়াগ্রার চেয়েও শতগুণ উত্তেজক। এই টাকা নিয়ে কারবার ব্যাংকের। ব্যাংক শক্তিশালী একটি বস্তুকে নিজের কাছে, নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখে। তাই ব্যাংকের গুরুত্ব একটি দেশের রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে অপরিসীম।
রাজনীতির সাথে টাকার একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। পৃথিবীতে যত শক্তি আছে টাকা তার মধ্যে অন্যতম, এটা রাজনীতির চেয়েও শক্তিশালী, পেট্রোলের চেয়েও দাহ্য, নারীর চেয়েও লাবণ্যময়ী এবং ভায়াগ্রার চেয়েও শতগুণ উত্তেজক। এই টাকা নিয়ে কারবার ব্যাংকের। ব্যাংক শক্তিশালী একটি বস্তুকে নিজের কাছে, নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখে। তাই ব্যাংকের গুরুত্ব একটি দেশের রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে অপরিসীম।
আমরা সবাই জানি ব্যাংকের কাজের পরিধি। এটা জনগনের
সঞ্চিত ও কষ্টার্জিত টাকা একত্রিত করে, পরবর্তীতে সেই টাকা যাদের দরকার তাদেরকে ঋণ
হিসেবে দেয়। ব্যাংক যারা টাকা রাখেন তাঁদের কাছে খুব বিশ্বাসের একটা জায়গা। একটা
দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকের গুরুত্ব খুব বেশী কারণ ব্যাংক হচ্ছে একটা দেশের
অর্থনৈতিক শরীরে ধমনীর সমান যার কাজ টাকাকে রক্তের মত ধমনীতে ধমনীতে অর্থাৎ
বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রবাহিত করা। রক্তের প্রবাহ কমে গেলে শরীর যেমন
অসুস্থ হয়ে পড়ে তেমনি টাকার প্রবাহ অর্থনীতিতে কমে গেলে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
একটি দেশের অর্থনীতিতে কি পরিমাণ ব্যাংক লাগবে তা
নির্ণয়ের জন্য সে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থান, লোকসংখ্যার পরিমাণ, ব্যবসা
বাণিজ্যের পরিমাণ, ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা, অর্থনীতির আকার ইত্যাদি একটা বিবেচ্য
বিষয়। তাছাড়া যদি সে অর্থনীতিতে এনজিও, কো-অপারেটিভ বা অন্য কোনধরনের ক্রেডিট
প্রবাহ চালানোর মত সংগঠন থাকে, মারসেন্ট বাঙ্কস থাকে, ষ্টক এক্সচেঞ্জ থাকে যারা
ব্যবসায়ে টাকা বিনিয়োগে অংশগ্রহণ করতে পারে বা মানুষের পুঁজি নিয়ে কাজ করতে পারে
তাহলে সেটাও বিবেচনায় আসতে পারে।
আমরা জানি
আমাদের দেশে বর্তমানে সরকারী, বেসরকারী
ও বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা আছে ৫৭টি,
৬টি আছে নন-সিডিউল্ড ব্যাংক এবং ৩৫টি আছে নন-ব্যাংকিং
আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং দুটি আছে বিশেষায়ীত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ৩৯টি
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে এরশাদের আমলে (১৯৮২-১৯৯০) অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৯ টি, বিএনপির আমলে (১৯৯১-১৯৯৬) দেয়া হয়েছে ৮টি আর বাকীগুলো সব আওয়ামীলীগের আমলে
অনুমোদনপ্রাপ্ত। সর্বশেষ রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমদনপ্রাপ্ত
৯টি ব্যাংকের অবস্থা যারপরনাই দুর্বল। বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না রাজনৈতিক বিবেচনায়
লাইসেন্স পাওয়া চতুর্থ প্রজম্মের নতুন নয় ব্যাংকের। বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও আগ্রাসী
ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়ায় দিন দিন বাড়ছে তাঁদের খেলাপি ঋণের বোঝা। পরিচালকদের মধ্যেও
ঋণ ভাগাভাগি নিয়ে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি কোন নিয়মসিদ্ধ
ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা। ফলে অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে লাভতো দূরের কথা মূলধনই
খেয়ে ফেলছে তারা। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক বিষয়ে
সতর্ক ও নির্দেশনা দিয়েও তাদের শৃঙ্খলায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে হুমকিতে পড়েছে এসব
ব্যাংক, ঝুঁকির
মধ্যে পড়েছে আর্থিক খাত। কথিত আছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও
রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পায় নয় ব্যাংক। তারপর অনুমোদন পাবার পর তাঁরা
বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতাধর হবার কারণে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করে না।
তাছাড়া এসব ব্যাংকের বেশিরভাগ পরিচালক ব্যাংকিং বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই।
আমানতকারীর অর্থের নিরাপত্তা দিতে তাই তাঁরা অনেকটাই ব্যর্থ।
যদিও ব্যাংকগুলোর
অনুমোদনের পূর্ব শর্ত ছিল,
কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেয়া এবং সেবায় নতুনত্ব আনা, কিন্তু নতুন
পণ্য তো দূরের কথা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আগ্রাসী ব্যাংকিং চালাচ্ছে তারা। ফলে
ব্যাঙ্কগুলো নানাবিধ বিতর্কে জড়িয়েছে নিজেদেরকে পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে তৈরি করেছেন
এক ভয়াবহ আতংক। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকের উপর মানুষের বিশ্বাস হারাবে। ফলে
অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
আমাদের দেশে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা আমাদেরকে বাংলা ছায়াছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। ছায়াছবিতে
দেখা যায় সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস ঘটিয়ে, খুন করে চলে গেলে তারপর পুলিশ এসে
হাজির হয়। ঠিক তেমনি ব্যাংকের ক্ষতি অনেকদূর অগ্রসর হলে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ
করে যা’ তাদের
নিজেদের ভিতরের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও অন্তঃসারশূন্য ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর
কিছুই নয়। সম্প্রতি ফারমার্স ব্যাংকের সব খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়। সাধারণ মানুষের
কাছে এই বার্তা গেল যে ব্যাংক শেষ হয়ে গেলে তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক কঠিন হস্তক্ষেপ
করলো। অনিয়মের দায় মাথায় নিয়ে চেয়ারম্যান
পদ ছেড়েছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। পুনর্গঠন হয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। এমডি এ কে এম
শামীমকে অপসারণের নোটিশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ
ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী,
চতুর্থ প্রজম্মের এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। গেল বছরের
সেপ্টেম্বর শেষে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ
বিতরণ ঋণের ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশই খেলাপি। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ২৩৮ কোটি
টাকা। শীর্ষ ১০ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই ব্যাংকটির পাওনা ১৩৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ
ব্যাংকটির আসল খেয়ে এখন ৭৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার
বন্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব এখন ব্যাংকটি ঠিক মতো চলছে কি না, তা নজরে রাখছে
নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। হয়ত এই দেখভাল আগে থেকে করলে সমস্যা এত প্রকট হত না। তাঁদের
কাছে কোন ব্যাংক খারাপ হবার অনেক পূর্বেই তথ্যগুলো জমা হতে থাকে। সেই তথ্য
বিশ্লেষণ করে তাঁরা পূর্বেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে অনেক ব্যাংকই হয়ত গভীর
সঙ্কটের হাত থেকে রেহাই পেত। দেখা যাচ্ছে
পরিচালনা পর্ষদের করা অনিয়ম ও দুর্নীতির ফল ভোগ করছেন আমানতকারীরা ও
ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা। প্রশ্ন হচ্ছে যে পর্ষদ অন্যায় করলো, অনিয়ম করলো
বা দক্ষতা দেখাতে পারলনা এবং যে এমডি ও সিইও তার প্রশিক্ষিত বাহিনী দিয়ে পর্ষদকে
সহায়তা করলো, ব্যাংকের
ক্ষতি করলো তাঁদের কি হল বা হবে, কোন শাস্তির আওতায় আনা হবে কিনা। একটি সুগঠিত
সরকারী মালিকানাধিন বেসিক ব্যাংক ধ্বংসের পেছনে যে ব্যক্তি সেই আব্দুল হাই
বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে কোর্টের হস্তক্ষেপের পরে- এই উদাহরণ
আমাদেরকে আশ্বাস দিতে ব্যর্থ যে রাজনৈতিক বিবেচনায় পাওয়া ব্যাংকগুলোর ধ্বংসের
পেছনে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রাখছেন তাঁরা কখনো আইনের
আওতায় আসবেন।
শুধু
ফারমার্স ব্যাংক নয়,
রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রায় সব ব্যাংকের বিরুদ্ধেই
অভিযোগ হচ্ছে তাঁরা ব্যাংক পরিচালনায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে পারচেনা ফলে
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। প্রায় সব ব্যাংকই পত্রিকার পাতায় স্থান পাচ্ছে
অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের উদাহরণ হিসেবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেগুলো দেয়া হয়নি তাঁদের
অবস্থা এগুলোর চেয়ে ভাল।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গেল বছরের
শেষের দিকে জানিয়েছেন,
আরও তিনটি নতুন ব্যাংক অনুমোদন দিবে সরকার। গত কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক খাতের ঋণ
কেলেঙ্কারি আলোচিত ঘটনা। সর্বশেষ অনুমোদন পাওয়া কয়েকটি ব্যাংকও ঋণ কেলেঙ্কারিসহ
তারল্য সঙ্কটে ধুকছে। এই অবস্থায় আরও ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া যৌক্তিক কি না- এ প্রশ্নের
উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেছেন,
‘সমস্যা নেই। আমাদের অনেক ব্যাংক আছে ঠিক, কিন্তু তারপরও প্রচুর অঞ্চল ব্যাংক
সেবার বাইরে আছে। এ কারণেই নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।’
কথাটি হাসতে
হাসতে উনি বলেন শুনতে খারাপ লাগেনা কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। পূর্বে যেসব ব্যাংক যে
উদ্দেশ্যের কথা বলে দেয়া হয়েছে তাঁরা কি সেই শর্ত পালন করছে? করছে না।
তাহলে কেন আবার নতুন ব্যাংক একটা দায়সারাভাবে দিতে হবে? এটা একটা ক্রম্বর্ধনশীল
রাষ্ট্র, শুধু
কতিপয় ব্যবসায়ী, দলের
লোক, দলের
স্বার্থের পক্ষের লোক তাঁদের কেন রাস্ত্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সুবিধা দিতে হবে? এটা কি
সরকারের জন্য ভাল হবে?
আজ সারা দেশের লোকজন জানে ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থা, এই সময়ে
কারা সরকারকে প্রভাবিত করে আবার নতুন ব্যাংকের অনুমোদন নিচ্ছেন, তাঁরা কি
সরকারকে বিপদে ফেলতে চান?
তা’ নাহলে
কেন এইরকম উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে দেশের, সার্বিকভাবে সরকারী দলের কোন উপকার
হবে না ক্ষতি ছাড়া?
সামনে
নির্বাচন, দেশের
অর্থনীতিতে, আন্তর্জাতিক
পরিমণ্ডলে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি বেশ ভাল, ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার ভাবমূর্তি অনেকের কাছে ঈর্ষার বিষয় এই সময় নতুন নতুন সিদ্ধান্ত যা অর্থনীতিতে
বিশেষ কোন অবদান রাখবে না বা দলে বিশেষ কোন পালক যোগ করবে না সে রকম আত্মঘাতী
সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকতে সরকারকে অনুরোধ করি।
অনেক বড় বড় অর্জন ছোট ছোট খারাপ কাজের কারণে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ম্লান
হয়ে যায়, নিষ্প্রভ
হয়ে পড়ে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু সরকারের কতটুকু উপকার
করেছে আমরা জানিনা, কিন্তু
আমরা বুঝতে পারি কতটুকু ক্ষতি করেছে। ক্ষমতা একধরনের কালো চশমা পরিয়ে দেয়
ক্ষমতাসীনদের চোখে যা দিয়ে শুধু স্বস্তির ও স্তুতির আকার চেনা যায়, একধরনের আলো
সামনে উদ্ভাসিত হয়, অন্ধকার
বা খারাপ মুখ লুকিয়ে থাকে,
দেখা যায়না, তাকে
দেখতে হলে কালো চশমা বিহীন চোখ লাগে। ক্ষমতার শক্তি চশমাকে খুলতে শেখায় না, নতুন নতুন
কালো চশমা পরতে শেখায়।
সরকারের
কাছে বিনীত অনুরোধ করবো অন্তত রাজনৈতিক বিবেচনায় কোন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন না
দিতে। ব্যাংকিং খাতকে সঠিকভাবে, স্বাধীনভাবে চলতে দিন। বাংলাদেশ ব্যাংককে তার দায়িত্ব
সঠিকভাবে পালন করতে দিন তাতে সরকারের ভাল কাজ আরও আলোকিত হবার সুযোগ পাবে।
ব্যাংকিং খাতের এই দুর্দিনের মধ্যে আবার নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা একটা
বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না বলেই মনে হয়।
সাইফুল
হোসেন- লেখক, কলামিস্ট ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, কেন অর্থনৈতিক বিবেচনায় নয়!!
Reviewed by FinPowers.Com
on
February 12, 2018
Rating:

No comments: