কাঁদেনা বাবা
সাইফুল হোসেন
বাবা, কেমন আছো তুমি? ভাল আছো বাবা? আমি না একটুও ভাল নেই। তোমাদের ছাড়া কীভাবে ভাল থাকি বল? আম্মু, ছোট আপি, তুমি,
তোমরাই ছিলে আমার পুরা পৃথিবী। অথচ কতদিন তোমাদের সাথে
আমার দেখা হয়না, কথা হয়না। কতদিন হবে যেন? তুমি কি মনে করতে পার
বাবা? আমি মনে করিয়ে
দেই। আর এক সপ্তাহ পরেই এক বছর হবে। তোমাদের থেকে আমি অনেকদুরে, তাই না বাবা?
তোমার আদরের
আম্মুকে তোমার মনে পড়ে বাবা? জানো আমার কিন্তু
তোমাদের কথা খুব মনে পড়ে। সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে তোমার কথা। তুমি অফিসে যেতে আর আমার অপেক্ষার পালা শুরু হত। ঠিক সন্ধ্যার পর পরই তুমি
বাসায় ফিরতে। দরজায় একটা বেল দিলেই বুঝতাম তুমি এসেছ। আমি দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলতাম।
তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে উপরে তুলে একটা ঘুর দিতে। আমি খুব মজা পেতাম, হাসতাম। মাঝে
মাঝে খুব ভয় পেতাম কিন্তু তোমাকে বলতাম না। মনে আছে বাবা তুমি একদিন চকোলেট আর
একদিন আইসক্রিম নিয়ে আসতে। তোমার পকেট হাতড়াতাম আমরা দুবোন। কিছু না কিছু থাকতোই।
বাবা তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহুর্তও থাকতে পারিনা। আমার চোখ দিয়ে শুধু
পানি পড়ে। কেন এমন হল বাবা? কার কাছে আমি এর উত্তর পাবো বলতে পার তুমি?
বাবা, তোমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আমি কেমন আছি, কোথায় আছি, তাই না বাবা? আমি সব
জানি। আমি খুব ভাল আছি বাবা, ভীষণ ভাল। সবখানে যেতে পারি, যখন যেখানে চাই। আমি সারাক্ষণ পাখিদের সাথে খেলি। ইচ্ছে হলেই আমি আকাশের তারাদের সাথে জ্বল জ্বল করতে পারি। এখানের বাগানগুলো দারুন
সুন্দর। কত শত ফুল এখানে, গোলাপ,
বেলি, জুই, জবা, রজনীগন্ধা, সূর্যমুখী। এত এত ফুল সবার নাম
আমি জানি না। এখানে কত মজা। কোন পড়াশুনা নেই, মারামারি নেই, বকা ঝকা নেই। শুধু খেলা আর খেলা। শোন বাবা, আমার
অনেক খেলার সাথী আছে। ওরা সবাই খুব ভাল। কত মজা করি আমরা! জানো বাবা, সবাই খুব আদর করে আমাকে। এত কিছুর পরও আমার ভাল লাগে না বাবা। আমার শুধু তোমাদের কথা মনে পড়ে। তুমি, আম্মু, আপি আর দাদু যদি থাকতে আমার একটুও
কষ্ট হত না।
বাবা, আম্মু কি এখনো অফিসে যায়? ছোট আপি কত বড়
হয়েছে বাবা ? ও কি স্কুলে যায়? ওকি আমার
কথা বলে? আম্মু খুব কাঁদে তাই না ? আমারও আম্মুর জন্য খুব কষ্ট হয় বাবা।
তোমাকে একটা
কথা বলার জন্য খাতা কলম নিয়ে বসেছি বাবা। তুমি ভাবছ আমি লেখাপড়া কীভাবে শিখলাম? শিখেছি। এখানে আমাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য
একজন মাষ্টার মশাই আছেন। তিনি খুব ভাল । সবাইকে খুব আদর করেন। প্রতিদিন সকালে আমাদের কত রকমের চকলেট দেন। উনি সবসময় হাসিমুখে
থাকেন। কখনো রাগ করেন না। আমরা উনাকে খুব জ্বালাই, তারপরও রাগ করেন না। আব্বু রাগ করা নাকি
খুব খারাপ। তুমিও তো কখনো রাগ করনি আমাদের সাথে। তুমি খুব ভাল, বাবা।
আচ্ছা বাবা জরিনা
কোথায়? ও কি বেঁচে আছে? ওকে কি
পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে? ও কোথায় আছে এখন? শোন জরিনা ভাল না বাবা। তুমি আর আম্মু অফিসে গেলে আমরা কিছু
বললেই জরিনা আমাদেরকে মার দিত। আমার জন্য যে খাবার থাকত তাঁর প্রায়
সব ও খেয়ে নিত। আমি কিছু বললেই গালে কষে থাপ্পড় দিত। আপিকেও মারত। শোন, একদিন
আমি আর আপি একটা কার্টুন দেখছিলাম, আর জরিনা চাচ্ছিল বাংলা ছবি
দেখতে। আমরা কান্না কাটি করছিলাম বলে আমাদের দুজনের গলা এত
জোরে টিপে ধরে রেখেছিল যে আমরা শ্বাস নিতে পারছিলাম না। আপি বলেছিল তোমাকে বলে
দিবে। এই শুনে জরিনা রান্নাঘর থেকে বটি এনেছিল আমাদের জবাই করবে বলে। ওমা কি ভয় পেয়েছিলাম! আমরা তোমাদের আর কিছু
বলিনি বাবা। বললে ঠিকই তার পরের দিন তোমরা অফিসে গেলে আমাদের সত্যি
সত্যি জবাই করে দিত।
আচ্ছা, তোমরা দুইজনে চাকুরী না করলে আমাদের চলতো না বাবা? আমরা না হয় একটু কম খেতাম, একটা কমদামী বাসায় থাকতাম,
কমদামী জামাকাপড় পড়তাম কিন্তু তোমাদেরকে তো কাছে পেতাম, ঠিক বলেছি না বাবা?
বাবা, আমি জানি
তুমি প্রতি রাতে খুব কাঁদো। তুমি তো বড় মানুষ তাই আস্তে আস্তে
কাঁদো। তোমার ঘুম হয়না আমার জন্য আমি জানি। তুমি আমাকে কত ভালবাসতে! আমি এখন কি করবো বাবা, তোমার কষ্ট আমি কীভাবে
দূর করবো? আমি চাইলেও তো আর তোমার বুকের মধ্যে ফিরে আসতে পারি
না, পারি বল? এখান থেকে তো ফেরা যায় না
বাবা। পারলে আমি কখন চলে আসতাম!
জানো বাবা, আমি আম্মুকে একদিন বলেছিলাম যে জরিনা আমাদের মারে। কিন্তু আম্মু না বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস করবে কি করে? জরিনা তো আম্মুর সামনে আমাদেরকে মারধর করত না, বরং অনেক আদর করত। আপু ছাড়া কথা বলত না। আর তোমরা বাসা থেকে
চলে গেলেই ও পাল্টে যেত; সামান্য কারনেই আমাদের
গালাগালি করত; শূয়রের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা
আরও কত নোংরা গালি। ও সব আমি তোমাকে বলতে পারবো না বাবা।
বাবা, এখনো তুমি প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আমার জন্য বেলুন আর চকলেট
কিনে আনো আমি জানি। কেন কেনো ? কেন অত কষ্ট করে রোজগার করা টাকা নষ্ট কর তুমি ? আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি বাবা, এই দেখ এত বেশী ভালবাসি। তুমি আসবে না তোমার আম্মুকে দেখতে? কবে
আসবে বাবা? আমি যে অপেক্ষা করে আছি। তুমি কিন্তু একা এসোনা; আম্মুকে আর আপিকে সাথে
করে নিয়ে এস। আর শোন দাদুকেও একটু এনো। আমি দাদুকেও একটু দেখতে
চাই। আম্মু যদি না আনতে চায় তবুও। জানো বাবা, দাদু না আমার জন্য খুব কাঁদে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি।
সেদিন কি
বার ছিল যেদিন জরিনা আমাকে মেরে ফেলল? মনে আছে তোমার? ও মনে পড়েছে। রবিবার। সন্ধ্যা বেলা । তুমি আর আম্মু আমাকে
বাসায় জরিনার কাছে রেখে আপিকে নিয়ে বাজারে গেলে। আপির জন্য একটা স্কুল
ব্যাগ কিনতে। আমি টিভিতে কার্টুন দেখছিলাম। জরিনা স্টার প্লাস দেখবে বলে আমার কাছ থেকে রিমোর্ট কেড়ে নিল। আমি জোরে কাঁদতে লাগলাম। তুমি তো জানো আমার খুব চিৎকার করে
কাঁদি। জরিনা আমাকে জোরে ধমক দিল। আমিও ধমক দিলাম। ও আমাকে একটা থাপ্পড় দিল। আমারও খুব মেজাজ খারাপ হল। অন্যদিন আমাকে মারলেও আমি কিছু বলিনা কিন্তু ঐদিন আমার মন খুব খারাপ ছিল কারণ তোমরা
আমাকে নিয়ে যাওনি। আমিও জরিনাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে ছিলাম। তারপর কাঁদতে কাঁদতে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার গ্রিলের কাছে। জরিনা দৌড়ে এসে আমাকে একনাগাড়ে কিল-ঘুষি,
থাপ্পড় মারতে থাকে। আমিও দুই একটা মারলাম। আমি ওর সাথে পারি বল বাবা? আমিতো অনেক ছোট। আমার থাপ্পড় খেয়ে ও আরও রেগে গেল। ও আমার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে জোরে
জোরে আঘাত করতে থাকে। আমি বাবাগো মাগো বলে চিৎকার করতে লাগলাম। কেউ কিছু বলেনি বাবা, পাশের বাসার কেউ সাহায্য
করতে এগিয়ে আসেনি। আমার মাথা ফেটে রক্ত বের হতে থাকে বাবা। কি কষ্ট উহ! তারপর আমি আর কিছু বলতে পারিনা। ও আমাকে তোমাদের সাথে থাকতে দিলনা। ওর যেন শাস্তি হয় বাবা।
আমি কতবার তোমাকে
বলেছি, আম্মুকে বলেছি দাদুকে আমাদের বাসায় এনে রাখতে। তুমি আমাকে বলেছিলে আম্মু রাজী হয়না। কেন বাবা, দাদু তো তোমার আম্মু সে আমাদের সাথে থাকলে আম্মুর কি ক্ষতি?
আর আমার দাদু আমাদের বাসায় থাকবে তাতে আম্মুর অনুমতি
লাগবে কেন বাবা? নাকি তুমিও চাওনা দাদু আমাদের সাথে থাকুক?
তোমাদের বড়দের ব্যাপার আমি ঠিক বুঝি না। কেন তোমরা এমন বলতো; কেন তোমরা বড় হলে বাবা-মাকে ভুলে যাও, তাঁদের ভালবাসতে ভুলে যাও ? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। একটু বলবে বাবা? আপিও কি বড় হলে তোমাদেরকে ভুলে যাবে? আমি কিন্তু ভুলতাম না।
তোমাদের বড়দের ব্যাপার আমি ঠিক বুঝি না। কেন তোমরা এমন বলতো; কেন তোমরা বড় হলে বাবা-মাকে ভুলে যাও, তাঁদের ভালবাসতে ভুলে যাও ? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। একটু বলবে বাবা? আপিও কি বড় হলে তোমাদেরকে ভুলে যাবে? আমি কিন্তু ভুলতাম না।
তোমাকে একটা অনুরোধ করি বাবা। আপিকে দেখে রেখো। ও বড় হচ্ছে। আর কোন জরিনার উপর ভরসা করোনা প্লিজ। দাদুকে বাসায় নিয়ে এসো। তুমি তো জানো, দাদু তাঁর গ্রামের বাড়ীতে একা একা থাকে, একা রাঁধে? তাঁর কি কষ্ট হয়না বাবা? একা থাকা অনেক কষ্টের। আমাকে দেখে বুঝনা? আমি জানি একা থাকলে মানুষ মনে মনে মরে যায়। আমাকে কথা দাও বাবা আম্মুকে বুঝিয়ে বলবে। আম্মুকে বলবে আমি তোমাকে বলেছি। দেখবে সে অবশ্যই রাজী হবে। আম্মুও তো খুব ভাল বাবা। তাছাড়া আম্মু ও তো একদিন দাদুর মত বুড়ো হবে, হবে না বাবা?
তোমরা বড়রা যেন কেমন। আমরা ছোটরা যেমন রাগ ভুলে সহজেই কাউকে ভালবাসতে পারি, তোমরা কিন্তু তেমন পারনা বাবা। ক্ষমা করতে শেখ , যেমন আমরা ছোটরা করি। দেখবে তোমাদের পৃথিবীটা আমাদের ছোটদের পৃথিবীর মত সুন্দর ও সহজ হবে, আনন্দে আনন্দে ভরে যাবে। ভাল থেকো বাবা, চিঠি পড়ে কাঁদবে না যেন।
আরে তুমি তো কাঁদছ বাবা। তুমি কাঁদলে আমি কীভাবে থাকব একটু বলতে পার? লক্ষ্মীবাবা আমার, কাঁদেনা। দেখো তো তোমার কান্না দেখে আমার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। ও বাবা প্লিজ কেঁদনা, লক্ষ্মী সোনা বাব্বা আমার।
তুমি অপেক্ষায়
থেকো আমি আবার লিখব।
ইতি তোমার আম্মু।
সাইফুল হোসেনের গল্প-- কাঁদেনা বাবা
Reviewed by FinPowers.Com
on
February 20, 2018
Rating:
No comments: