করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতি: সঙ্কটের অশনি সঙ্কেত


-সাইফুল হোসেন 

 people, free vectors, mood, wallpaper, dark, free vectors, sorrow,depression sad, blue,artworks

পুরো পৃথিবী এত নীরব, এত ভয়ংকর শান্ত হয়নি কখনওকরোনাভাইরাস পৃথিবীর মহাব্যস্ত মানুষদের অর্ধেকের বেশী সংখ্যককে বাধ্য করেছে ঘরের মধ্যে নিজেদের বন্দী করতে স্মরণকালে মানবজাতিকে এমন অসহায় হতে দেখিনি আমরা
  
এটা ঠিক, বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। কিন্তু বিশ্বের অতিধনী সব দেশ যখন এই বৈশ্বিক মহামারীতে বিপদগ্রস্ত, আমাদের অবস্থা যে অনেক খারাপ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবু বিপদ একদিন কেটে যাবে-- তা যত বড়ই হোক না কেন-- কিন্তু এই মহামারী-পরবর্তীতে যে দারিদ্র, বেকারত্ব, আমদানি-রপ্তানিতে সঙ্কট, শ্রমিক ও সাধারণ কর্মজীবী মানুষের অভাব, পণ্য পরিবহন-সংক্রান্ত জটিলতা ও আর্থিক বিশৃঙ্খলাসহ নানা সমস্যার উদ্ভব হবে সেগুলো মোকাবেলা করা হবে কীভাবে? তার প্রস্তুতি কি এখনই নেওয়া হবে নাকি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা? এসবই এখন ভাবার বিষয়।

আমরা জানি, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পরিচয় বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, শিল্পপ্রধান দেশ হয়ে উঠছে দেশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ (প্রক্ষেপণ) অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে, শিল্পের অবদান ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, কৃষি ও নির্মাণ খাত এই পাঁচ খাতের অবদান মোট জিডিপির ৬৭ শতাংশ। কৃষি-যন্ত্রপাতি, সার ও ভালো বীজের জন্য আমরা আমদানির উপর নির্ভর করি। শিল্পখাতের মেশিনারি, যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের জন্যও। আবার একই চিত্র পরিবহন ও নির্মাণ খাতের বেলায়।

এসব কারণেই করোনা-পরবর্তী প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে অনেক গভীর। সরকার এবং ব্যক্তিখাতের ব্যবসায়ীদের এখুনি ভাবতে হবে বর্তমানের ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যাবে এবং যে অর্থনৈতিক মহাসঙ্কট আসছে তা কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে এ নিয়েকরোনা মোকাবেলা নিয়েই কেবল চিন্তা করলে তা হবে একপেশে-- সমন্বিত কিছু হবে না।

মনে রাখতে হবে, এই বৈশ্বিক মহামারীতে পৃথিবীর সব মোড়লরা অসহায় হয়ে পড়েছে, পৃথিবী হয়ে পড়েছে নেতৃত্বশূন্যএই মুহূর্তে নিজেদের সক্ষমতার পুরোটা আন্তরিকতার সঙ্গে ও সমন্বিতভাবে ব্যবহার করতে হবে। যেখানে আমেরিকার অর্থনীতিতে করোনা-পরবর্তী প্রভাব হিসেবে বেকারত্বের হার ৩০ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাষ, সেখানকার অর্থনীতির আকার অর্ধেক হয়ে যাবে এমনটাও বলা হচ্ছেএমন পরিস্থিতিতে আমাদের অবস্থা কতটা ভয়ানক হতে পারে তা আমরা অনুমানও করতে পারছি না।

সরকার গার্মেন্টস খাতের জন্য ৫০০০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখেকারণ শুধু এই খাতে প্রায় ৪১ লাখ শ্রমিক কাজ করেন (যদিও এটি সঠিক তথ্য কিনা তার স্টাডি নেই) এই টাকা যাদের পাবার কথা তারাই যেন পায়, মালিকদের পকেটে না ঢোকে সেটা নিশ্চিত করা জরুরী। এই অর্থ বন্টনের দায়িত্ব যদি ব্যাংক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মাথা গুনে গুনে শ্রমিকদের দেওয়া হয় অথবা সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক বা বিকাশ অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয় তাহলে সেটি নিশ্চিত করা যেতে পারে, অন্যথায় নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যান্য রপ্তানি খাতে যে শ্রমিকরা রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কী হবে? তাছাড়া রপ্তানি-নির্ভর নয় এমন শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদেরও প্রণোদনা দেওয়া হবে কিনা সেটা সরকারকে জানাতে হবেতা না হলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না।

সমাজের নিম্নবিত্তের সব মানুষ যথাযথভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাবেন কিনা এটাও ভাবনার দাবী রাখে বৈকি। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি যেন প্রক্রিয়াটি ব্যাহত না করে সেদিকে সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

আপদকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় বিপদের মধ্যে পড়েন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ এরা আর্থিক কষ্টে পড়বেন দারুণভাবে, কিন্তু কেউ তাদের পাশে থাকবে না। সরকার দেবে না তাদের কোনো সহায়তা। আবার তারা হাতও পাততে পারবেন না লজ্জায়ফলে এই শ্রেণীর একটা বড় অংশ সমাজের নিচের স্তরে চলে যাবেনপ্রশ্ন হচ্ছে, এই মধ্যবিত্তকে বাঁচাবে কে? এই মহাপ্রলয়ের কালে সরকার কি সেটা ভেবে দেখবেন?

আমাদের অর্থনীতিতে বেকারত্বের হার ৪.২৯ শতাংশ (২০১৯)। প্রতি বছর ২০-২২ লাখ শিক্ষিত বেকার যুক্ত হচ্ছেন এই তালিকায়। তার উপর, করোনা-সংকটের ফলে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন কয়েক লাখ কর্মী। এরা আবার তাড়াতাড়ি সেসব দেশে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না।

ওদিকে যেসব কলকারখানা বন্ধ হয়েছে সেগুলো স্বাভাবিক হতে কত মাস সময় লাগবে তা সবার অজানা। যেসব কারখানার কার্যাদেশ বাতিল হয়েছে সেগুলো কি অতিসত্ত্বর কাজ শুরু করতে পারবে? মনে হয় না। তাহলে বেকারত্বের হার কোথায় গিয়ে ঠেকবে?

অনেক ছোট এবং মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে বন্ধ হবে বেশ কিছু বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও এর ফলেও অনেকে বেকার হবেনমানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে অস্বাভাবিকভাবে। ব্যবসায়ীরা তাদের কর্মচারীদের বেতন কোথা থেকে দেবেন? তাদের সক্ষমতার জায়গাটা কোথায়?
ব্যাংকগুলো হয়তো জুন পর্যন্ত ঋণকে ক্লাসিফাই করবে না, কিন্তু এই ক’মাসের আরোপিত সুদ তারা কোথা থেকে দেবে? অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য বিলের টাকা পরিশোধ কীভাবে সম্ভব? বিষয়গুলো নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে এখুনি। প্রয়োজনে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় কমিটি গঠন করে নতুন পলিসি তৈরি করতে হবেনইলে ভয়াবহ বিপদ আসবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে যেগুলোর মোকাবেলা অসম্ভব

শেয়ার বাজার অনেকদিন যাবত খারাপ যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট চরমে। এখন যুক্ত হতে যাচ্ছে আর্থিক অভাব। এই মার্কেটে যদি সরকার বিনিয়োগের প্রবাহ ঠিক রাখতে না পারে তবে বাজার বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হবে। বিনিয়োগকারীরা যেন শেয়ার বিক্রির জন্য উঠেপড়ে না লাগেন সেটি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। টাকার অভাব ও ভয় দুটো কারণেই শেয়ার বিক্রি করবেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। মনে রাখতে হবে, নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ইতোমধ্যে ৩০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। মার্কেট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ভবিষ্যৎ কী হবে কেউ জানে না। তাই আমাদের দেশের বাস্তবতায় সরকার পদক্ষেপ না নিলে শেয়ার বাজারকে রক্ষা করা যাবে না

করোনা-ভীতি কাটিয়ে মানুষ যখন বাইরে বেরুবে তখন চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু অনেকের হাতে টাকা থাকবে কম। কারও কারও হাতে থাকবেই না। আবার বাজারে চাহিদা অনুপাতে জোগান কমবে পণ্যের দাম যাবে বেড়েএর সঙ্গে যদি কিছু মানুষের সুযোগসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি যোগ হয়, তবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে ব্যাপক

অন্যদিকে, পরিবহন ব্যবস্থায়ও সঙ্কট তৈরি হতে পারে। ফলে পণ্যের জোগান থাকলেও পণ্য পৌঁছুতে বিলম্ব হবে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় পণ্য পরিবহনের কাজটি দক্ষ করতে হবে। আমদানিকৃত পণ্যের বেলায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে
যারা বিদেশ থেকে ফিরেছেন, আবার যারা নতুন করে যাবার জন্য তৈরি হয়েও যেতে পারেননি তাঁদের ক্ষেত্রে কি হবে? আমাদের রেমিটেন্স আয়ে যে মারাত্মক প্রভাব পড়বে তার মোকাবেলা সম্ভব কিভাবে?

সব সমস্যা উত্তরণ করার জন্য পলিসি তৈরি করা দরকার এখনই। যখন বিপদ আসবে তখন করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে।

-সাইফুল হোসেন
             
কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল




করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতি: সঙ্কটের অশনি সঙ্কেত করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতি: সঙ্কটের অশনি সঙ্কেত  Reviewed by FinPowers.Com on April 06, 2020 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.