- সাইফুল হোসেন
করোনাভাইরাস কতদিন তার প্রাণঘাতী তাণ্ডব চালিয়ে যাবে, পৃথিবীর অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর কী পরিমাণ প্রভাব রাখবে, পৃথিবীর কী পরিমাণ ক্ষতি করবে- তা আমরা কেউই এখন বলতে পারি না। তবে একটি কথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, পৃথিবী আগের মতো থাকবে না আর। অর্থাৎ, করোনা-পূর্ববর্তী পৃথিবী আর করোনা-পরবর্তী পৃথিবী কখনো এক হবে না। গুণগত ও মানগত পরিবর্তন হবে বিস্তর; এমন বিস্তর- যা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
কোনো পারমাণবিক বোমার তাণ্ডব নয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়, এমনকি দৃশ্যমান কোনো শত্রু নয়; শুধু একটি অণুজীব- যার প্রভাবে পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষেরা এতটা অসহায় হয়ে গেল যে, সামনে যেন তাদের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। নিকট অতীতে, এমনকি দূর অতীতেও মানবসভ্যতা এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়নি। ক্ষুদ্র একটি অণুজীব সৃষ্টির সেরা মানবজাতিকে তার ক্ষুদ্রতা ও নগণ্যতার কথা মনে করিয়ে দিল।
বিশ্ব এখন স্তব্ধ। ৭৭৮ কোটি মানুষের বিশ্বে এখন প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ ঘরবন্দি, ২১০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস- করোনা। বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও দেশ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করছে, পূর্বাভাস দিচ্ছে।
ওইসিডির মহাপরিচালক এঞ্জেল গুরিয়া সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, করোনাভাইরাস গুরুতর আকারে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির হার অর্ধেক কমে তা ১.৫%-এ দাঁড়াবে বলে সম্প্রতি যে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, তাও এখন খুবই আশাবাদী একটা পূর্বাভাস বলেই মনে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি ভাবে দেশগুলো দ্রুত তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলে উঠতে পারবে, তাহলে সেটা হবে একটা 'স্তোকবাক্য'। অন্যদিকে, জেপি মর্গানের মতে, পরপর আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা বিশ্ব অর্থনীতিতে দুই দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটাবে, যা গোটা যুক্তরাজ্যের জিডিপির সমান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান মন্দায় পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনাভাইরাস এশিয়ার কয়েক কোটি ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জীবন-জীবিকাকে আরও ঝুঁকিতে ফেলেছে। এতে গরিবরা আরও গরিব হবে। এমনকি ধনী দেশগুলোকে তাদের ব্যবসা ও গৃহস্থালী টিকিয়ে রাখতে লড়াই করতে হবে।
চীন, যেখানে এই করোনাভাইরাসের সূচনা হয়েছে, সেখানকার ব্যাংক বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত বছরে শতকরা ৬.১ ভাগ থেকে ২০২০ সালে কমিয়ে শতকরা ২.৩ ভাগে নিয়ে আসবে, যদি এই মহামারি আরও খারাপ অবস্থায় না যায়। কিন্তু যদি অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়, তাহলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ বছরে শতকরা মাত্র ০.১ ভাগ অর্জিত হতে পারে। বিশ্বব্যাংক বলছে, দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে এক কোটি ১০লাখ মানুষের।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এই বলে সতর্ক করেছে যে, চলতি বছর এশিয়ার দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায় নামতে পারে, যা কি না গত ৬০ বছরের মধ্যে প্রথম। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে এশিয়ার সেবা খাত। কারণ, দেশে দেশে লকডাউনের কারণে বিমান চলাচল খাত, কারখানা, দোকান, রেস্তোরাঁগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এর আগে আইএমএফ অবশ্য জানায়, ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর এই প্রথম সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থায় বিশ্ব। এবার এশিয়ার প্রবৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক করল সংস্থাটি।
বিশ্ব অর্থনীতি ইতিমধ্যে ১৯৩০ সালের মহামন্দার চেয়ে খারাপ মন্দার মুখোমুখি আছে। তবে এরপরে আরও খারাপ একটি মন্দা আসতে পারে বলে সতর্ক করেছে লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। বিভিন্ন দেশের সরকার নিজ নিজ অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়তার জন্য কোটি কোটি ডলার সহায়তা প্যাকেজ দিচ্ছে। তারা যে সার্বভৌম ঋণ নিচ্ছে, তা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে দ্বিতীয় মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে মনে করছে ইআইইউ।
এটা গেল বৈশ্বিক অর্থনীতির পূর্বাভাস। আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা কি হবে সেটাই আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় আপাতত। আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে। আমাদের যদি তার অর্ধেকও হয়, তাহলেও ১ লাখ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে। করোনার প্রভাবে রপ্তানি আয়ের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ রেমিট্যান্সসহ আরও বেশকিছু খাত বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। প্রবাসী আয়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ২১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এই সংকটে প্রবাসী আয়ও অনেক কমে যাবে। পৃথিবীর অনেক দেশে আমাদের শ্রমিকেরা কাজ করছেন। সেসব দেশে বেতন কমে যাবে, অনেকে চাকরি হারাবেন। ফলে এইসব শ্রমিকরা দেশে ফিরলে (অনেকে ইতোমধ্যে দেশে ফিরেছেন) অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে পড়বে।
আমাদের মোট শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৮ লাখ, যার মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করেছে অন্তত নয় লাখ লোক আনুষ্ঠানিক খাতে কাজহীন হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ বা ৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার। শ্রম-অধিকার প্রায় বঞ্চিত বিশাল শ্রমশক্তির অধিকাংশই কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের ছয়টি শিল্প-অধ্যুষিত এলাকার সব খাত মিলিয়ে শিল্প কারখানা আছে ৭ হাজার ৪০৮ টি, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, এরমধ্যে ৬ হাজার ৪২৩টি বা ৮৭ শতাংশ শিল্পকারখানাই কোভিড-১৯-এর আতঙ্কে বন্ধ হয়ে গেছে। দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে সাড়ে ২০ ও ১০ শতাংশ (প্রায় চার কোটি)।
অন্যদিকে পিপিআরসি-বিআজিডির করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। শহুরে দরিদ্র মানুষদের আয় গত ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ৮২ শতাংশ কমে গেছে। আর গ্রামের দরিদ্র মানুষের আয় কমে গেছে ৭৯ শতাংশ। তিন ধরনের দরিদ্র শ্রেণির আয় গড়ে ৭৬ শতাংশ কমে গেছে (প্রথম আলো, ১৬ মার্চ, ২০২০)।
সাম্প্রতিক এই বিপর্যায়ের সময় সরকার অবশ্য বসে নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন ইতোমধ্যে। প্রণোদনা প্যাকেজটি মূলত অর্থনীতির গতি যেন তরান্বিত হয় সেজন্য, বিশ্বব্যাংক, এইএমএফ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে নিম্নমুখিতার কথা বলেছে, সেই নিম্নমুখিতাকে কাটিয়ে যেন আবার পূর্বের অবস্থানে ফেরা যায় সেজন্য। এই উদ্যোগের আমরা প্রশংসা করি। যদিও ৫০ হাজার কোটি টাকার যে প্যাকেজ করা হয়েছে সেটা কিভাবে দেশের সব ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাকে পৌঁছে দেওয়া যাবে, সেটা পরিষ্কার নয়।
ব্যাংকার গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে হবার কারণে ব্যাংকের বর্তমান ভালো গ্রাহকেরা এই সহায়তা আগে পাবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে যে গ্রাহক ব্যাংকের অপরিচিত, সে কিভাবে ওই সুযোগ পাবে, সেটাও পরিষ্কার না হবার কারণে তারা বঞ্চিত হবার সম্ভাবনাই বেশি থেকে যাচ্ছে। সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা ছোট ও কুটিরশিল্পকে দিতে চেয়েছে তা যদি ব্যাংকের মাধ্যমে না দিয়ে এনজিও এবং যারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করে তাদের মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা করত, তাহলে এই পদক্ষেপ আরও কার্যকরী হতো বলে প্রতীয়মান হয়।
যাহোক, আমাদের ক্রমবর্ধনশীল অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি শ্রমিক শ্রেণি। সংখ্যায়-বেশি-দক্ষতায়-কম-স্বল্প-বেতনের এই শ্রমিক শ্রেণি আমাদের দেশের শিল্পোন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই সমাজকে টিকিয়ে রাখতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। বর্তমান সংকট মধ্যবিত্তকে ও শ্রমিক শ্রেণিকে যে আর্থিক বিপদে নিপতিত করেছে, সেখান থেকে তাদেরকে বাঁচানো দরকার- যদি আমরা অর্থনীতির গতিকে সঙ্কট-পরবর্তীতে আবার তরান্বিত করতে চাই।
এই সঙ্কটে যদি সমাজের একটা বড় অংশ শ্রেণি না খেয়ে মারা যায় এবং মনোবল ও কর্মনিষ্ঠা হারিয়ে ফেলে, তাহলে তাদেরকে আমরা ফেরাব কীভাবে? সরকারের তিন বছর মেয়াদী পরিকল্পনাকে সফল করতে হলে সাময়িক পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজের একটা বৃহৎ শ্রেণিকে নগদ সহায়তার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মানুষ বেঁচে থাকলে উন্নয়ন দরকার, মানুষ যদি না থাকে তবে উন্নয়ন কার জন্য?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক উদ্যোগ এবং এই দুর্যোগকালীন সময়ে তার পরিশ্রম ও সার্বিক কাজে অংশগ্রহণ আমাদের আশান্বিত করে যে তিনি পারবেন এই দুর্যোগকালীন সময়ে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে; কিন্তু তার দলের ও সরকারের সতর্ক ও সৎ অংশগ্রহণ না হলে এবং সমাজের সবার অংশগ্রহণে একটি সমন্বিত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে না পারলে আমরা যতটা এগিয়েছি স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত, তা এই করোনা-সৃষ্ট দুর্যোগ ম্লান করে দিতে পারে। তাই এখন আমাদের বেঁচে থাকার সময়, দেশকে বাঁচানোর সময়, জনগণ যে দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ- তা প্রমাণ করবার সময়। আমরা আবার জেগে উঠব, বেঁচে উঠব; আমরা দেশকে পিছিয়ে থাকতে দেব না।
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
সিইও, ফিন পাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল
উন্নয়ন কি কাজে আসবে যদি মানুষ না বাঁচে!
Reviewed by FinPowers.Com
on
April 28, 2020
Rating:
No comments: