সাইফুল হোসেন, কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঋণের সুদের
হার কমে যদি ৯ শতাংশ হয় তাহলে ব্যবসার খরচ কমবে, আয় বাড়বে, লাভ বাড়বে, বিনিয়োগ
বাড়বে এটাই খুব স্বাভাবিক, ঘটার কথা তাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সময় অর্থাৎ ১লা এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর হলে দেশের
অর্থনীতির জন্য একটি ভাল খবর হবার কথা কিন্তু আমি মনে করি এই সাম্প্রতিক ঘোষিত
বেঁধে দেওয়া সুদের হার সার্বিকভাবে দেশের কল্যাণে বিশেষ কোন কাজে আসবে বলে মনে হয়
না সঙ্গত কারণে।
বিগত
অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের আর্থিক খাতে তারল্য সঙ্কট বিদ্যমান। পরবর্তীতে পুরা
সময় জুড়ে এই ক্রাইসিস কমা’র বিশেষ কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। অর্থের জোগান ঠিক না
থাকার নানাবিধ কারণ থাকে। হতে পারে দেশের টাকা বাইরে পাচার হয়ে গেছে, ব্যাংক থেকে
যে টাকা ঋণের আকারে বের হয়ে গেছে সেই টাকা আর ফেরত আসছে না, আবার হতে পারে দেশের
টাকা দেশেই আছে কিন্তু সেটা ব্যাংকিং চ্যানেলে নেই, অন্য কোথাও আছে। যেখানেই
থাকুক, ব্যাংকিং চ্যানেলে না থাকলে বা বৈধ চ্যানেলে না থাকলে সেটা দিয়ে ঋণের
প্রবৃদ্ধি হয় না। ঋণের প্রবৃদ্ধি না হলে তার বহুবিধ প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। ঋণের
প্রবৃদ্ধি না হলে, বিনিয়োগ বাড়েনা, নিয়োগ বাড়ে না, আয় বাড়েনা, সঞ্চয় বাড়েনা,
বাড়েনা ব্যয় ফলে প্রবৃদ্ধি আটকে যায় অর্থনীতিতে।
আমাদের
দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বড় বেশী সঙ্কটের মধ্যে পড়ে আছে। ব্যাংকিং খাত থেকে যে টাকা
ঋণ হিসেবে বের হয়ে গেছে তার অসহনীয় একটা অংশ আর ফেরত আসেনি, ঋণের বড় একটা অংশ খেলাপী ঋণে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৯ সালের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। আমাদের এই হার মোট
বিতরণকৃত ঋণের ১১.৪০ শতাংশ। দ্বিতীয়
অবস্থানে ভারত এবং তৃতীয় স্থানে আছে ভুটান ও আফগানিস্তান, যাদের খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯ ও ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১.৪০ শতাংশ খেলাপি ধরলেই আমরা শীর্ষে তাহলে
যদি প্রকৃত চিত্র আমাদের সামনে আসে যেটা নিয়ে এসেছে আইএমএফ যা আমরা ইতোমধ্যে জানি তাহলে
আমরা কোথায় আছি সেটা সহজেই অনুমেয়। আইএমএফ বলছে আমাদের
খেলাপি ঋণের পরিমান মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২২ শতাংশ। তাঁরা যেভাবে হিসেব করেছে আমি ব্যক্তিগতভাবে
মনে করি সেটাই প্রকৃত হিসেব যদিও তারমধ্যেও সংশয় থাকতে পারে।
যাহোক ব্যাঙ্কে
তারল্য প্রবাহ এবং ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া এবং ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড বাড়ার অন্যতম
কারণ এই খেলাপি ঋণ। ব্যাংকের সুদের হার কমানোর যে কথা বলা হচ্ছে বা
সাম্প্রতিককালে যে সুদের হার সরকার বেঁধে দেয়ার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তার কোন
প্রয়োজন হতনা যদি এই খেলাপি ঋণের পরিমান আকাশ ছোঁয়া না হত। কারণ ব্যাংকগুলো তখন অর্থের
চাহিদা ও জোগানের উপর নির্ভর করে নিজেরাই সুদের হার ঠিক করে নিত বা মার্কেট নিজেই
নিজের প্রয়োজনে সুদের হার ঠিক করে দিত যা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত হত।
সরকার ব্যবসায়ের
খরচ কমানোর জন্য, শিল্পের বিকাশসাধন এবং ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যাতে না বাড়ে সেজন্য স্বপ্রণোদিত
হয়ে ডেপোজিট ও ঋণের উপর সুদের হারবেঁধে
দিয়েছে- সেটাকে সাধুবাদ জানানো যায় কারণ উদ্দেশ্য খুব ভাল কিন্তু যদি ফলাফল আপনি
বিশ্লেষণ করেন তাহলে ভালোর চেয়ে মন্দ দিকটাই বেশী করে সামনে চলে আসবে। একটি দেশের
সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা হচ্ছে সরকারের কাজ। সরকার যখন কোন সিদ্ধান্ত নিবে তখন তা সমাজের সব খাতের সব মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই নেবে। আর কল্যাণ
হচ্ছে মোটাদাগে একজনের ক্ষতি না করে অন্যজনের উপকার করা। আবার কোন সিদ্ধান্ত যদি
সার্বিকভাবে সমাজের জন্য সুফল বয়ে নিয়ে আসে তাহলে সেটাও কল্যাণের বাইরে নয়। কিন্তু
ব্যাংকের ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করলে উপকৃত হবেন ব্যাংক থেকে যারা ঋণ
নেন তাঁরা সাথে ঐ ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে বিভিন্নভাবে যারা জড়িত পরোক্ষভাবে
তারাও। ফলে ব্যবসার আর্থিক খরচ কমবে, ব্যবসার প্রসার হবে,
লাভ বাড়বে, সরকার ট্যাক্স বেশী পাবে, নিয়োগ বাড়বে, নতুন ব্যবসার সম্প্রসারন হবে; সবই খুব ভাল, মন্দের কিছু নেই। কিন্তু খেলাপি এখন যে
হারে আছে বা বাড়ছে সেই হার যদি ঠিক থাকে তাহলে এই ব্যবসায়ের খরচ কমে লাভ কতটুকু
হবে? তাছাড়া যে যুক্তিতে সুদের হার কমানো হচ্ছে সেই যুক্তিটি
ধোপে টিকবে না কারণ এখানে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক
সফলতার জন্য বা ঋণপ্রাক্তির যোগ্যতা থাকলেই ঋণ পাওয়া যায় না, ঋণ পেতে অন্যান্য
যোগ্যতা, উপর মহলের সাথে যোগাযোগ ও বাড়তি টাকার সাহায্য লাগে। যদি
হঠাৎ এই দেশ এমন এক আদর্শ দেশে রুপান্তরিত
হয় যে বাইরের কোন প্রভাব, রাজনৈতিক অগ্রাধিকার বা ঘুষের বিনিময়ে ঋণ
হবে না, ঋণ প্রাপ্তি নির্ভর করে ব্যবসায়িক যোগ্যতার উপর, তাহলে সুদের হার কমানো
অতীব যুক্তিযুক্ত। যদি এমন হয় সুদের হার কমলো, সাথে ঋণ
খেলাপও বাড়ল এবং বর্তমান খেলাপি ঋণ অনাদায়ী থাকলো তাহলে ব্যাংকগুলোর টিকে থাকাই
কঠিন হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে ঋণের
সুদ কমাতে গিয়ে তাঁদের সঞ্চয়ের উপর সুদের হার কমাতে হবে। সরকার সেটা সর্বোচ্চ ৬
শতাংশ তে নির্ধারণ করেছে। আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেবার সুবিধা এখনো ৩০ শতাংশের
বেশী মানুষ পায়নি। শহুরে যারা অবসরে গেছেন তাঁরা মুলত ব্যাঙ্কে বা সরকারী
সঞ্চয়পত্রের উপর নির্ভর করেন। শহরের বাইরের লোকজন ডাকঘর সঞ্চয় স্কিম ও সঞ্চয়পত্রের
উপর নির্ভর করেন। সরকারকে বাধ্য হয়ে ঐ সুদের হারও কমাতে হবে। যদিও ডাকঘর
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে আবার পূর্বের অবস্থানে সরকার ফিরে গেছেন তবুও এক সময়
তাঁদের ঐ হার কমাতে বাধ্য হতে হবে যদি ঋণের উপর ৯ শতাংশ সুদ ধরে রাখতে হয়। তাহলে
অনেক বড় একটা শ্রেণী যারা সুদের উপর নির্ভর করে চলে তাঁরা বঞ্চিত হবে। তাঁরা কিভাবে
সংসার চালাবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন কারণ তাঁদের কোন প্রত্যক্ষ আয় নেই। আসলে সরকারি এই সুদনীতির কারণে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সবারই ক্ষতি হবে।
দেখতে হবে যত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উপকৃত কি তার চেয়ে বেশী মানুষ হবে? সমগ্র দেশের মানুষকে হিসাবে নিলে
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বেশী হবে।
সামগ্রিক বিচারে মনে হয় পূর্বের মত সুদের হার ব্যাংকের হাতে থাকাই ভালঃ
ব্যাংকের জন্যও ভাল, সাধারণ মানুষের জন্য ও ভাল। বরং ব্যাংক অন্যান্য যে চার্জ
নেয়, দন্ডসুদ নেয়, কমিশন নেয় সেটা কমানোর দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। ব্যবসাগুলো
তাঁদের ওয়েস্টেজ কমানোর দিকে নজর দিতে পারে, কর্মীদের ট্রেইনিং দিয়ে দক্ষ করে তুলে
খরচ বাঁচাতে পারে। বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা সরকারের অধিক মনোযোগ দেওয়া উচিত খেলাপি ঋণ
আদায়ের দিকে। ঋণ খেলাপিরা যে ব্যাংক ঋণের টাকা
পাচার করে কানাডাতে বেগমবাড়ি বানিয়েছে, আমেরিকা, মালায়েশিয়াতে সেকেন্ড হোম করেছে
এবং বিদেশী ব্যাঙ্কে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে জমিয়েছে তাঁদের ব্যাপারে
শক্ত অবস্থান সরকার নিতে পারে। সরকার আন্তরিক হলে অর্থপাচারের টাকা দেশে ফেরানো
অসম্ভব নয়। মানুষ খুনের চেয়ে যারা দেশের অর্থনীতিকে খুন করেছে তাঁরা কোন অংশে কম
অপরাধী নয়। সরকার যদি পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে পারে তাহলে দেশের ব্যাংকিং
সেক্টরের চেহারা পালটে যাবে। সরকারের উচিত শুধু টাকা আদায়ে ব্যাংক কমিশন গঠন করা, ব্যাংক
এবং ব্যাংকসংক্রান্ত সার্বিক কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তাহলে সুদের হার
বাজারের নিয়মেই কমে আসবে, সরকারকে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে না।
-
সাইফুল হোসেন
কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল
Email: hossain.shaiful@gmail.com
সরকারের নয়-ছয় সুদনীতির কার্যকারিতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
Reviewed by FinPowers.Com
on
April 06, 2020
Rating:

No comments: