প্রশ্ন হচ্ছে, একই পরিবারে চারজন পরিচালক থাকলে অসুবিধা কোথায়? আর টানা নয় বছর যদি তারা পরিচালক থাকেন, তাতেই বা সমস্যার কী আছে? আগের আইনে কী এমন সমস্যা হলো যে, অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও বিলটি পাস করতে হলো? বিষয়গুলো আলোচনার দাবি রাখে সঙ্গত কারণে, যেহেতু ব্যাংক শুধু কতিপয় লোকের ব্যবসা করার জায়গা নয়; বরং এটা এমন একটা প্রতিষ্ঠান, যার আছে সামাজিক দায়বদ্ধতা।
দেড়-দুই বছর ধরে এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে বিষয়টি নিয়ে। এমন বিশেষ কোনো প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাইনি, যেটা নতুন আইনটি পাসের ব্যাপারে ইতিবাচক মতামত প্রদর্শন করে। বরং ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা বারবার বিষয়টির বিরোধিতা করেছেন, বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সমাজের সচেতন শ্রেণী। তবে পক্ষ নিয়েছে বিএবি বা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস। বলা যায়, তাদের পীড়াপীড়ি ও তদবিরের কারণে আইনটি পাস হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের আলোচনায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে তাদের দুই ধরনের মতামত পাওয়া যায়। এক. তারা ভাবেন যে, কষ্ট করে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন, অন্যদের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন কেন! দুই. তারা ব্যবসায়ী, তারা বোঝেন কীভাবে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়, অন্যরা এটা ভালো করে চালাতে পারবেন না। প্রতিটা কথার মধ্যে কিছু যুক্তি আছে।
একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে এখন ৪০০ কোটি টাকা পেইড-আপ ক্যাপিটাল লাগে। সুতরাং যারা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, তারা ওই টাকাটা ব্যবস্থা করেন এবং বিনিয়োগ করেন। কম ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার নয়। কেন তারা অন্যদের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে নিজেরা অনিরাপদ থাকবেন? কথাটা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটি ব্যাংক কত টাকা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে? কোনো কোনো ব্যাংক ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা। আমি বেসরকারি খাতের ব্যাংকের কথা বলছি। ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকার আমানত নিয়ে ব্যাংক পরিচালকরা ব্যাংকের তহবিল নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেক্ষেত্রে যদি আমানতকারীদের টাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ে, তাহলে তার দায়িত্ব কে বা কারা নেবে? তাছাড়া সবাইকে একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, ব্যাংক আর অন্য একটা প্রাইভেট বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এক নয়। একটা ব্যাংকে যারা পরিচালক থাকেন, তাদের যে অংশগ্রহণ থাকে, তা মোট পুঁজির ১০-১২ শতাংশের বেশি নয়। তাহলে বাকি ৯০ শতাংশের পুঁজির জোগানদার যে সাধারণ জনগণ, তাদের দিকটা, তাদের নিরাপত্তার দিকটা নিশ্চিত করবে কে? আবার যতক্ষণ সবকিছু ঠিকমতো চলে, পরিচালকরা তাদের কর্মপ্রণালি সঠিক নিয়মনীতি মেনে পরিচালনা করেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ঠিকমতো বজায় থাকে, ততক্ষণ কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যাংক খাতের অভিজ্ঞতা ভিন্ন তথ্য দেয়। খুব ভালো কোনো তথ্য দেয় না। বেসিক ব্যাংক যে শিক্ষা আমাদের দেশের ব্যাংক খাতকে উপহার দিল, তা স্মরণকালে মানুষ ভুলতে পারবে না। ওটা তো একটা সরকারি ব্যাংক, তাদেরও শক্ত ম্যানেজমেন্ট ছিল, শুধু বোর্ড চেয়ারম্যানের অসততাকে ঠেকাতে পেরেছে কেউ? একজন শক্তিশালী বোর্ড চেয়ারম্যান কীভাবে একটা অসাধারণ ব্যাংককে ধ্বংস করতে পারেন, তার প্রমাণ সবার সামনে। আর নতুন যে আইন হয়েছে, তাতে একই পরিবারের চারজন পরিচালক যদি টানা নয় বছর থাকতে পারেন এবং তাদের কর্তাব্যক্তিটি যদি অসৎ হন, তখন ব্যাংকের কোনো ধরনের করপোরেট গভর্ন্যান্স থাকবে কীভাবে? ব্যাংকের টাকা যদি নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে বের করে দেন, তখন বাধা দেয়ার কে থাকবে? বর্তমান অবস্থাতেই ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, বোর্ড ব্যাংকের যেকোনো জায়গাতেই হস্তক্ষেপ করে— নিয়োগ হোক, প্রমোশন হোক বা ঋণ বিতরণ। তাহলে সংশোধিত আইনে কীভাবে ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে? ব্যাংক খাতে এই যে অলিগোপলির ব্যবস্থা করা হলো, সেটা তাহলে কার স্বার্থে? কতিপয় ব্যাংক পরিচালকদের স্বার্থে? দেশের সাধারণ জনগণ, আমানতকারী, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী কারো স্বার্থ দেখা হলো না! কেন হলো না— এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এ আইন পাসের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে যে কলঙ্ক লেপন করলেন, তার জন্য সারা জীবন জনগণের কাঠগড়ায় খারাপ একটা উদাহরণ হয়ে থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ব্যাংক একটা দুর্দান্ত পেশাদারিত্বের কাজ, ব্যাংক সবাই চালাতে পারেন না। যারা ব্যাংক পরিচালনা করেন, তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, সততা আর পেশাদারিত্ব থাকতে হয়। সাধারণ ব্যবসা আর ব্যাংকিং ব্যবসা এক নয় কোনোভাবে। পরিচালকরা হয়তো ব্যবসা ভালো বোঝেন, ব্যাংকিংও যে ভালো বুঝবেন, সেটা বলা কঠিন। তবে চেষ্টা করলে যে শিখবেন না, তা নয়। এমন অনেকে আছেন, যারা অনেক অভিজ্ঞ ব্যাংকারের চেয়েও ভালো বোঝেন ব্যাংকিং। তবে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক আমাদের যে অভিজ্ঞতা দেয়, সেটি আদৌ ভালো নয়। একটা সুন্দর ব্যাংক আস্তে আস্তে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে পরিচালনাসংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে। ফারমার্স ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল সদ্য খারাপ হয়ে যাওয়া দুটো ব্যাংক। ব্যাংক দুটিতে এমডি ছিলেন, দক্ষ ম্যানেজমেন্ট ছিল, তার পরও শক্তিশালী বোর্ড সদস্যদের প্রভাব তারা এড়াতে পারেননি। ফলে তারাও বোর্ড মেম্বারদের অসততা ও অদক্ষতার ভাগী হয়েছেন, তারাও জড়িয়েছেন অপরাধ প্রবণতায়। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এখন যদি দুদক বা সরকারি অন্যান্য সংস্থা কোনো ব্যবস্থা নেয়, তবে ফাঁসবে সর্বাগ্রে ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট। পরবর্তীতে বোর্ড মেম্বারদের ডাক পড়তেও পারে আবার নাও পড়তে পারে। তাছাড়া বোর্ড মেম্বাররা এত শক্তিশালী যে, রাষ্ট্রযন্ত্রও হিমশিম খায় তাদের প্রসঙ্গ এলে। তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক গত বছরের ২৯ অক্টোবর কমিটির বৈঠকে বলেছিলেন— এক পরিবার থেকে চারজন একটানা নয় বছর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, এ বিষয়গুলো পুনর্বিবেচিত হওয়া দরকার। কমিটির অন্য সদস্যরাও সভাপতির বক্তব্যকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, বিলটি পাস হলে ব্যাংক খাত আরো বেশি পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। আরেক সদস্য বেগম আখতার জাহানের মত ছিল— বিলটি পাস হলে ব্যাংক খাত পরিবারকেন্দ্রিক হবে, মানুষের আস্থা হারাবে এবং এ খাতে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গত ২১ নভেম্বর কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই বিলটি পাসের সুপারিশ করে দেয় সংসদীয় কমিটি। পরবর্তীতে দুর্বল বিরোধী দলের প্রচণ্ড বিরোধিতার পরেও বিলটি পাস হয়ে যায় একপ্রকার সহজ-সরলভাবে। দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার প্রশ্ন— আইনটি তবে কেন পাস করা হলো? কার স্বার্থে সারা দেশের লোকের আপত্তি সত্ত্বেও পাস করা হলো?
সিপিডি তার পর্যালোচনায় গত বছরকে ব্যাংক কেলেঙ্কারির বছর হিসেবে অভিহিত করেছে। গেল বছর বাংলাদেশের ব্যাংক খাত যে খারাপ ও কলঙ্কজনক সময় পার করেছে, তা আর কখনো দেখা যায়নি। এখন আমাদের কি গেল বছরের চেয়েও খারাপ কোনো সময় দেখতে হবে ব্যাংক খাতে? সাধারণ জনগণের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে— ‘আমরা এখন যাব কোথায়, আমাদের কথা কে শুনবে, আমাদের দিকটা, আমাদের স্বার্থ কে দেখবে, আমরা কি অভিভাবকহীন হয়ে থাকব সবসময়?’
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। গত জুনে ঋণ বিতরণ ছিল ৭ লাখ ৩১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশই খেলাপি। এর মধ্যে সরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। গড়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণই খেলাপি। জুনের তুলনায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের দেশীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ ঋণই খেলাপি। জুনের তুলনায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।
নতুন সংশোধিত আইন যদি এ খেলাপি ঋণের বোঝা আরো বাড়িয়ে তোলে, তাহলে তা ভোগ করতে হবে সেই ৯০ শতাংশ জনগণকে, যারা এ আইনের বিরোধিতা করেছে। আমরা আশা করব ভালো কিছু হবে, কিন্তু আমাদের আশা কেন জানি দুরাশায় পরিণত হয়। আমরা চাই আলো কিন্তু দেখতে হয় নিকষ কালো অন্ধকার।
লেখক: ব্যাংকার
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
Reviewed by FinPowers.Com
on
January 31, 2018
Rating:

No comments: