
আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রী মাঝেমধ্যে খুব স্পষ্টবাদিতার পরিচয় দেন। কথাবার্তায় বিশেষ রাখঢাক রাখেন না। সত্য কথাগুলো সহজ-সরলভাবে ব্যক্ত করেন অবলীলায়, যা মাঝেমধ্যে তার নিজের দলের লোকদের বিব্রত করে। তবুও তিনি বলেন, এটা তার সুন্দর ও সরল মনের পরিচয়। ক্রমউন্নয়নশীল ও বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও গত কয়েক বছর ধরে স্থিতিশীল বলতে হবে। মুদ্রাস্টম্ফীতিও যে বছর বছর খুব বাড়ছে তা নয়। দেশে বিনিয়োগও বাড়ছে। তবে অনাশার কথা হচ্ছে, দেশে পালল্গা দিয়ে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ছে। ছোট একটা অর্থনীতিতে সরকারি-বেসরকারি মিলে ব্যাংকের সংখ্যা ৫৭টি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। তবে এতে ভয়ের কোনো কারণ নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান (ব্যাংক-বীমা) সমস্যায় পড়লে সরকার ফেলে রেখে যাবে না। যেভাবেই হোক টিকিয়ে রাখা হবে। অর্থমন্ত্রী এমন এক সময়ে এ কথা বললেন, যখন তারল্য সংকটের কারণে বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থাও আগের চেয়ে খারাপ। অনিয়ম-দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে এসব ব্যাংকের আর্থিক ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষক দিয়ে চলছে ১৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এর মধ্যে সাতটি সরকারি। এ অবস্থায় আরও তিনটি নতুন ব্যাংক দিতে যাচ্ছে সরকার।
আমরা সবাই জানি, ব্যাংক একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে জনগণ তাদের কষ্টার্জিত টাকা জমা রাখে টাকাগুলো নষ্ট হবে না, চুরি যাবে না এবং টাকা কমে যাবে না বরং বাড়বে, এই প্রত্যাশায়। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে আমরা গেল বছর কী দেখলাম, নতুন বছরেই কী কী দেখছি। কয়েকদিন আগে আমার এক পরিচিত ব্যক্তি ফোন করে পরামর্শ চাইছিলেন, ফারমার্স ব্যাংকে চেক দিয়ে টাকা পাচ্ছেন না। অ্যাকাউন্টে টাকা আছে; কিন্তু ব্যাংকের কাছে কোনো টাকা নেই; তাই ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। সেটা এমন কোনো বড় টাকাও নয়। সবার প্রশ্ন, টাকা তাহলে গেল কোথায়? টাকা অ্যাকাউন্টে আছে; কিন্তু ব্যাংকে নেই, কেন? ব্যাংকের কাজ, একজনের টাকা একটু কম সুদে নিয়ে অন্যজনকে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে টাকাটা ঋণ দেওয়া একটু বেশি সুদে। দুই সুদের যে পার্থক্য সেটা স্প্রেড- ওটাই ব্যাংকের আয়। তাই যদি হবে তবে ব্যাংক টাকাটা ঋণ দিয়েছে। কাদের ঋণ দিয়েছে? ব্যবসায়ীদের, যারা টাকাটা খাটিয়ে সুদসহ ব্যাংককে ফেরত দেবে। এই ঋণ কারা দেন, কারাই-বা এই ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচন করেন? নির্বাচন করেন ব্যাংকাররা। ঋণ পাস করে ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটি এবং বড় ঋণের ক্ষেত্রে বোর্ডের সদস্যরা। সব দেখেশুনে ঋণ দেওয়া হয়েছে; তবে ঋণের টাকা ফেরত আসছে না কেন? একটু তলিয়ে দেখলে দেখবেন, ঋণদানের জন্য ঋণগ্রহীতা নির্বাচনের সময় যত্ন নেওয়া হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বোর্ডের সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ছিল। কোথাও কোথাও এত তড়িঘড়ি করে ঋণটা দেওয়া হয়েছে যে, ভালোভাবে দেখার সময় দেওয়া হয়নি ঋণদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত কর্মকর্তাদের। কোথাও কোথাও ৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ ব্যাপারও আছে- এসব তো এখন বেরিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। এই যদি হয় ঋণদানের সময়ের যত্ন, তবে সেই ঋণ আদায় না হওয়া অস্বাভাবিক হবে কেন? ঋণের টাকা আদায় করতে গেলে দেখা যাবে বা যাচ্ছে, জমির দলিলপত্র ঠিক নেই। তাহলে বেচবেন কীভাবে? আবার দেখা যায়, এক জমি তিনবার-চারবার ব্যাংকে মর্টগেজ দেওয়া হয়েছে। এসব লম্বা প্রক্রিয়া। এসবের কারণে জমি বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা আদায় করা একধরনের অসম্ভব হয়ে পড়ে। জনগণ বিশ্বাস করে টাকা রাখছেন আর ব্যাংকগুলো সেই টাকা ঋণ দিচ্ছে; অবশেষে টাকাগুলো ব্যাংকে ফেরত আসছে না। বেচারা সঞ্চয়কারীরা যাবেন কোথায়? তাদের আশ্রয় দেবে কারা?
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গেল বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (মার্চ-জুন) ৭৩৯ কোটি টাকা এবং তৃতীয় প্রান্তিকে (জুন-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ঋণ অবলোপন করা ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজন বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর শেষ কোথায়, কারও জানা নেই। এতদিন ঋণ অনিয়মের বিষয়টি সরকারি ব্যাংকে বেশি ছিল, এখন দেখা যাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকেও একই চিত্র। অনেকে মনে করছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। ফলে খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে এত অস্থিরতা আগে এত দৃশ্যমান হয়নি কখনও। বেসিক ব্যাংকের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঋণ কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংকের নজরকাড়া অনিয়ম, এনআরবিসি ব্যাংকের দৃশ্যমান অনিয়মসহ সব কেলেঙ্কারি ব্যাংকিং খাতকে অস্থির করে তুলেছে। সাধারণ গ্রাহক যাদের টাকায় ব্যাংক চলে তারা খুব ভিতু-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা বুঝতে পারেন না, কোন ব্যাংকে টাকা রাখবেন। অনেকে আবার মাটির ব্যাংকে টাকা রাখার কথাও ভাবছেন। এভাবে যদি ক্রমাগতভাবে মানুষের আস্থার জায়গা নষ্ট হতে থাকে, তাহলে অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।
গেল বছরের প্রথম দিকে ব্যাংকে ছিল উপচেপড়া তারল্য। ব্যাংকাররা এই অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছরও হয়নি এখনি তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা। এটা বোধগম্য হওয়া সহজ কথা নয়। কোথায় গেল এত টাকা? কাদেরকে দেওয়া হলো এত টাকা, যা আর ফেরত আসছে না? বাংলাদেশ ব্যাংকের সব চোখ ফাঁকি দিয়ে এত সব কাণ্ড হয়েছে নাকি তারা কিছুই বুঝতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি টিম কি সব টাকাপয়সা হাওয়া হওয়ার পরে খবর পায়, প্রশাসক বসানোর কাজ করে, তারা আগে কিছু বুঝতে পারে না? যদি আগে কিছু বুঝতে না পারে, তবে সত্যি মুশকিলের কথা।
ব্যাংক যখন বিভিন্ন কারণে বিপদে পড়ে, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসে। ব্যাংকিং খাত ধসে পড়লে পুরো অর্থনীতি বিকল হয়ে যাবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, যে নিজে অপরাধ করে দুর্বল হয়ে গেছে, তাকে আপনি কতক্ষণ অক্সিজেন দেবেন? এক ফারমার্স ব্যাংক যদি দাঁড়াতে না পারে, দিন না তাকে অন্য আর একটা ব্যাংকের সঙ্গে একাত্ম করে, যাদের ম্যানেজমেন্ট ভালো। তাহলে জনগণ একটা বার্তা পাবে যে, বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক খারাপ করলে তাকে মার্জারে যেতে হবে। আমি দোষের কিছু দেখি না। আমেরিকার মতো বড় অর্থনীতিতে কি এসব হচ্ছে না?
সরকারের উচিত ব্যাংকগুলোকে সঠিক ও নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে নিয়ে আসা। যে দেশে ১৬ কোটির বেশি মানুষ সে দেশের অর্থনীতি নিয়ে ছেলেখেলার সুযোগ নেই। ব্যাংকগুলোতে ব্যাংকাররা স্বাধীনভাবে কাজ করুক, বোর্ড সেটা ওভারসি করুক নিয়মতান্ত্রিকভাবে, বাংলাদেশ ব্যাংক দক্ষতার সঙ্গে সব ব্যাংকের তদারকি করুক- এটা আমাদের প্রত্যাশা। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা না হয়ে অর্থনৈতিক বিচারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হলে দেশ উপকৃত হতো। বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে; কিন্তু তাকে শক্ত ভিত দিতে না পারলে ধসে পড়বে; এত মানুষের দেশ তখন খুব খারাপ সময়ে ঢুকে পড়বে।
আশা করি, অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং খাতের যথাযথ যত্ন নেবেন। ব্যাংকিং খাতে অর্থ আত্মসাৎ করে ফেরত দেয়নি, বিদেশে অনৈতিকভাবে টাকা পাচার করেছেন- তাদের বিচার করবেন। যে দেশে অপরাধি শাস্তি পায় না, সে দেশ উন্নত হবে কীভাবে? অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, যেসব ব্যাংক নিজের যোগ্যতায় টিকে থাকতে পারবে না, তাদের জোর করে টিকিয়ে রাখতে হবে কেন?
- সাইফুল হোসেন
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
hossain.shaiful@gmail.co
ব্যাংকিং খাত নিয়ে শঙ্কা
Reviewed by FinPowers.Com
on
January 20, 2018
Rating:
Reviewed by FinPowers.Com
on
January 20, 2018
Rating:

No comments: